নতুন বিয়ে

 

নতুন বিয়ে


রিয়া আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। কাঁধ বেয়ে কোমড় পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে চুল। ঘন, মিশমিশে কালো, লম্বা চুল। মাথা বাম দিকে একটু বাঁকা করে ডান হাতে চিরুনি নিয়ে ওর চুল আঁচড়ানো দেখে একটু হিংসে জাগছে। আমাকে বললে আমি কি আঁচড়ে দিতাম না !!
আমি মাঝে মাঝে কাথা সরিয়ে আড়চোখে রিয়ার চুল আঁচড়ানো দেখছি। রিয়া দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। রিয়া যখন হেসে হেসে কথা বলে তখন ওর গালদুটো টেনে দিতে খুব ইচ্ছা করে। রিয়াকে গতদিন একজোড়া কানের দুল এনে দিয়েছি। অবশ্য ওকে সরাসরি দেইনি। একটু অপ্রস্তুত লাগছিলো তাই ওর বালিশের উপরে রেখেছিলাম। কাগজে ছোট্ট করে অবশ্য একটা কথাও লিখেছিলাম। "আমার পক্ষ হতে প্রথম"
হঠাৎ রিয়া পেছন ফিরে আমার দিকে তাকালো, আমি সাথে সাথে চোখ মুজে ফেললাম। টিপটিপ করে চোখ মেলে দেখলাম রিয়া মুচকি হাসছে। রিয়া কি তাহলে বুঝতে পেরেছে আমি লুকিয়ে দেখছিলাম ওকে ! পেছনে ঘোরার জন্য চুলগুলো সরে যাওয়াতে ওর কানে আমার দেয়া দুলজোড়া দেখতে পেলাম।
নিজেকে হঠাৎই খুব সৌভাগ্যবান মনে হলো।
হঠাৎ আম্মু ডাক দেয়ায় রিয়া উঠে পাশের রুমে গেলো।

গত সাতদিন আগে আমার আর রিয়ার বিয়ে হয়েছে, পারিবারিকভাবে অবশ্য মজার ব্যপার হলো আমি এবং রিয়া দুজনেই এখনো পড়াশোনা করছি। আমার পড়াশোনা অবশ্য আর কিছুদিন পরেই শেষ হবে অবশ্য সাথে পার্টটাইম একটা জব করছি সফটওয়্যার ফার্মে। আমার আম্মাজানের ভাষ্যমতে আমি নাকি ইদানিং উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গেছি, তাদের কোনো কথাই নাকি গুরুত্ব দিয়ে শুনি না। আর এটার ফলাফল দিয়েছে আমার শত্রু আমার কাজিন মীম এবং স্বর্ণা। ছোটবেলা থেকে কম মাইর খাওয়ায়নাই আমাকে আর এবারে বড় শাস্তি দিয়ে আমার চিরশত্রু হয়ে গেলো ওরা।

হঠাৎ করেই সপ্তাহখানেক আগে আম্মা বললো আগামীকাল তোর বিয়ে, এসময় বাইরে যাবার দরকার নাই। আমি ভেবেছিলাম বাদ্য-বাজনা নাই, সানাই নাই এটা আবার বিয়ে নাকি !! আর মেয়েদের তো বাইরে যেতে নিষেধ করে। আমার সাথে হয়তো মশকরা করেছে। তবে সেটা যে মশকরা ছিলো না সেটা স্পষ্ট বুঝেছি পরদিন।
সত্যি দেখি পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার বেডে পান্জাবী - পায়জামা, পাগড়ী। থ্রি কোয়ার্টার - টি শার্ট পড়ে ছিলাম, সেটা পড়েই ব্রাশ হাতেই কোনোভাবে বের হয়েছিলাম। ছোট মামা কে এতোদিন সবথেকে কাছের মানুষ ভাবতাম। কিন্তু হাতি খাদে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে। মামাও যে আমাকে ঘরে রেখে বাবা মা কে ফোন করে ডেকে আনবে কে জানতো !

অবশেষে নিমরাজি হয়ে বিয়ে করতেই হলো। বাসর ঘরের সাথে এতো দ্রুত পরিচয় হয়ে যাবে ভাবিনাই। বাসর ঘর ! আহহহহ ! আগে এই শব্দটা নিয়ে কত কৌতুহল ছিলো। বন্ধুদের সাথে কত আলোচনা করেছি এই বাসর রাত নিয়ে।  আর এখন আমি সেই ঘরে ঢোকার অপেক্ষায়। ইতস্তত বোধ হচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল না !  আচ্ছা আব্বা আম্মা কোন আক্কেলে আমার মতো কম বয়সী একটা ছেলের বিয়ে ঠিক করে ফেললো !
-
কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো ?
-
নাহ ভাবছি।
-
যা ভাবার ভেতরে গিয়ে ভাবিস যা।
আব্বার কথায় লজ্জা পেলেও মনে হলো ঠিকই তো যাই না আগে ভেতরে....
রিয়া আমাকে দেখে বেড থেকে নেমে সালাম করলো। আমি কি করবো বুঝতে পারছিনা। ওকে উপরে টেনে তুললাম। ও আমাকে সালাম করায় নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান আর বড় মনে হলো। ওর মাথায় হাত রেখে বললাম, সুখে থাকো। বলেই কেমন জানি লাগলো। এই কথা তো বড় মানুষরা বলে।
-
এই আপনি কি পাগল !
-
রিয়ার এমন আক্রমণাত্মক কথায় আমি চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নিলাম।                                   - কেনো বললেন এই কথা !
-
নিজের বউকে এইটা কেউ বলে ?
বলবেন ভালো কথা কিন্তু বুকে জড়িয়ে নিলে কি হতো ! বলেই মুচকি হেসে ফেললো রিয়া। হাসিটাতে পেলব, মায়াবী একটা ব্যপার আছে। খরগোশের মতো ছোট ছোট দাঁতগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠছে। রিয়ার প্রথম কথাতেই বুঝে গেছি মেয়েটা চঞ্চল আর সেই সাথে দুষ্টু।
সেদিন সারারাত দুজনে অনেক গল্প করেছি। রিয়ার বাচ্চা বাচ্চা স্বভাবটা আমার কাছে দারুণ লাগে। যখন আম্মুর কাছে বাচ্চাদের মতো আবদার করে তখন আমি মুচকি হাসি। অবশ্য অভিমান হয়। আমি ওর জামাই অথচ আমাকে কোনো আবদার করে না।
সেদিন অবশ্য রিয়ার জন্য ফুল এনেছিলাম। আম্মু সামনে পড়ায় লুকিয়ে রেখেছিলাম। আম্মু হয়তো বুঝতে পেরেছিলো। মুচকি হেসে বলেছিলো, আমার ছেলেটা দেখি বড় হয়ে গেছে।
রিয়ার সাথে কথা বলতে একটু অস্বস্তি কাজ করে। এটা ঠিক ওইরকম অস্বস্তি না। তবুও একরকম অস্বস্তি। ওই যে খুব প্রিয়দের সাথে কথা বলতে যেমন অস্বস্তি লাগে তেমনটা। রিয়াও আমার সাথে একটু অপ্রস্তুত হয়ে কথা বলে। কোনো কথা বলতে একটু সময় নেয়।


.
- শুনছেন !
কাজে মনোযোগী ছিলাম, রিয়ার ডাকে ঘুরে তাকালাম।
-
হুম বলুন।
-
নাস্তা খেতে আসুন।
হ্যা আসছি আপনি যান। যদিও আমরা দুজন দুজনাকে আপনি করে বলি কিন্তু দুজনের মাঝে ভালোবাসা, আন্তরিকতার একটা অংশ গড়ে উঠছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। রিয়া চুলগুলো এতো সুন্দর করে বেঁধেছে ! যে চীনা মেয়েরা পেছনে কেমন করে যেনো লম্বা করে বাঁধে !! মন বলছে কি যেনো মোহনীয় এক সুগন্ধ লুকিয়ে আছে। ওর লম্বা চুলগুলোয় নাক ডুবিয়ে দিলে কি রাগ করবে !! নাহ থাক পরে ওকে এই বিষয়ে বলবো।
দুজনের মাঝে ধীরে ধীরে ভালোবাসা গড়ে উঠছে সেটা স্পষ্ট। তিন বেলায় রিয়া আমাকে ছাড়া ডাইনিং টেবিলে বসে নাই। খুব দেরী করে আমিও বাসায় আসি না। নতুন বিয়ে করলে অবশ্য সবাই অফিস ফাঁকি দেবার চেষ্টা করে। যদিও আমি ফাঁকি দেবার চেষ্টা করি না। কারণ এই বিয়ের ব্যপারে আমার বস কয়েকমাসের সিনিয়র তাই তিনি আমাকে একটু আগেই বাসায় যেতে বলেন। কখনো ফুল, নয়তো চকলেট নিয়ে আর না হলে ওর জন্য কাঁচের চুড়ি, কানের দুল। রিয়ার মুখে তখন যে হাসিটা ফুটে উঠে তা ভাষায় বর্নণা করা মুশকিল।
কয়েকদিন পর আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে খবর আসলো যে আমার দাদিশ্বাশুড়ি আমাকে দেখতে চেয়েছেন। বিয়েতে অসুস্থতার জন্য উনি হসপিটালে ছিলেন তাই আসতে পারেন নাই। তবে আমার কাছে একটু বিরক্তই লাগলো ব্যপারটা। এখন নতুন বউকে যেমন দেখার জন্য লোকজন আসতো সেরকম নতুন জামাইকে দেখার জন্য জামাইকেই ঝক্কি পোহাতে হবে ....
যেমনটা হবে ভেবেছিলাম সেরকমটা নয়। সবার আগ্রহ সৌজন্যবোধে আমি অত্যন্ত আপ্লুত হয়েছি। রিয়ার দাদি তো আমাকে পাবার পর থেকে গল্পই করে যাচ্ছেন। রিয়া অবশ্য মাঝে মাঝে এসে দেখে যাচ্ছে। সমবয়সী, ছোট চাচাতো ভাইবোনদের সাথে রিয়া ঐদিকে খোশগল্পে মত্ত।
রাতে যখন প্রথমবারের মতো রিয়ার রুমে ঢুকলাম একটু অবাক হলাম। এই মেয়েটা আমার সাথে যেমন একদম বউ বউ আচরণ করে যেমন, ঠিকমতো নাস্তা খেতে বলা, ঘুমাতে বলা অথচ ওর রুমটা একদম বাচ্চাদের মতো। সারাদিন আত্মীয়স্বজনের সাথে সাক্ষাতের জন্য রিয়ার রুমে আসাই হয় নি।
রিয়া কিছু বলবে সম্ভবত তাই ঘুরঘুর করছে। কিছু বলবেন ??
-
আপনার কি ঘুম ধরেছে ?
-
না তবে ক্লান্ত লাগছে একটু।
-
আচ্ছা আপনি শুয়ে পড়ুন আমি আসছি।
শুয়ে শুয়ে ভাবছি .... বিয়ে নিয়ে যতটা ভয় ছিলো তার থেকে উল্টো দ্বিগুণ আনন্দ হচ্ছে। কতজন আমাকে নিয়ে খোশগল্পে মত্ত। কতজন আমায় দেখতে আসছে। একজন তো বলেই দিলো, রিয়ার কপালে রাজপুত্তুর জুটেছে। এসব ভেবে মনে মনে হাসতে হাসতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
-
এই শুনছেন ! (রিয়া)
চোখ খানিকক্ষণ ডলে দেখলাম রিয়া আমার কাছে বসে আছে।
-
আপনি ঘুমাননি ?
-
একটা জায়গায় যাবেন ?
-
এতো রাতে !
-
চলুন না....প্লিজ।
-
অত্যন্ত গভীর ছিলো আবদারটুকু। তাই রিয়ার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। দরজায় ওর চাচাতো ভাইবোন ভাই দাঁড়িয়ে ছিলো। বুঝলাম আগে থেকেই রিয়া সব বন্দোবস্ত করে রেখেছিলো।
এখন রাতের শেষ। রাতের শেষ মানে মধ্যরাত শুরু হবো হবো করছে। গ্রামের রাস্তাগুলো একটু রাত হতে এমনিতেই নিশুতি রাতের মতো হয়ে যায়। গ্রামের রাতগুলো অনেক গভীর হয়। রিয়া আর আমি একে অপরের হাত ধরে হাঁটছি। এখন ভাঙা চাঁদটা এই নিশুতি রাতে চারিদিকে আলো দেবার চেষ্টায় ব্যস্ত। রিয়ার চুড়ির আওয়াজে পরিবেশটা অনেক মনোরম লাগছে। রিয়াকে নিয়ে এই গভীর রাতে চাঁদের আলোয় হাঁটতে কি যে অনাবিল শান্তি খুঁজে পাচ্ছি বোঝানো যাবেনা।
সামনের ছোট ঝোপটাতে একটু শব্দ হলো। রিয়া আমার হাতটা একটু চাপ দিয়ে চেপে ধরলো।
-
আমার খুব শখ ছিলো, যে আমার বর কে নিয়ে আমি গভীর রাতে চাঁদের আলোয় ফাঁকা রাস্তায় হাঁটবো।
এতক্ষণ সামনে তাকিয়ে ছিলাম তবে রিয়ার কথা শুনে ওর দিকে তাকালাম।
চাঁদের আলোয় রিয়ার মুখটা এতো সুন্দর ভাবে ধরা পড়েছে যে কোনোভাবে কাউকে বুঝিয়ে বলা অসম্ভব...
-
আমার একটা আবদার রাখবেন ? (রিয়া)
-
বলুন
-
মাঝে মাঝে আপনার সময় হলে আমাকে নিয়ে এরকম রাতে ঘুরতে বের হবেন ?
এতটা আবেগ আর আবদারপূর্ণ কথা কেউ ফেলতে পারে কিনা জানিনা। তবে বউ তো আমার, আমারই ওর সব ইচ্ছা পূরণ করতে হবে।
অনেকক্ষণ পর মুখ খুললাম।
-
তাহলে আমার একটা আবদার পূরণ করবেন ?
-
রিয়া একটু আশ্চর্য হলেও বললো, কি ?
-
প্রতিদিন সকালে আপনার চুল আঁচড়ে দিবো আমি। রাজি ?
-
রিয়া একটু হেসে আমার হাত ওর দু হাতে চেপে ধরলো।
আমি বুঝলাম ওর উত্তরটা কি।

এখানে আসার সময় পায়েল কিনেছিলাম রিয়ার জন্য। পকেট থেকে বের করে রিয়াকে বললাম পরিয়ে দেই ? রিয়া শুধু হেসে মাথা নাড়ালো।
রিয়ার পায়েলের শব্দে আমার পরীর কথা মনে পড়ে গেলো। ছোটোবেলায় বড়রা গল্প শুনাতো যে গভীর রাতে নাকি পরীরা পৃথিবীতে নেমে আসে। আর ওরা আসলে নাকি রাত বিরাতে পায়েলের আওয়াজ শোনা যেতো। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে গেলে জানালায় কান পেতে থাকতাম পায়েলের শব্দ শোনার অপেক্ষায়, পায়েলের শব্দ মানেই যে পরীর আগমন। এখন আর পরীর দরকার নেই। পরী তো আমার পাশেই আছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা