ভয়ঙ্কর সুন্দর সেই জোছনা রাতে

ভয়ঙ্কর সুন্দর সেই জোছনা রাতে---নিশো আল মামুন

২০১১ সাল। থাকি লন্ডনের টেন সি বার্ড রোডের একটি বাসায়। সাথে থাকে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু দুলাল। কলেজের পড়ার চাপে দুজনেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। তিন মাস হলো, চাকরি করবো করবো করে করা হচ্ছে না।
হঠাৎ দুজনেই অর্থ কষ্টে পড়ে গেলাম। আগে সপ্তাহের প্রতি রবিবার রাতে একটা পার্টি হত। সে পার্টিতে দুজনেই উপস্থিত থাকতাম। এখন উপস্থিত থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এক রবিবার রাতে বাসায় পার্টি হচ্ছে। রান্না বান্নাও বেশ। পুরো রাত্রি ধরে সিটিং রুমে হৈ হৈ কাণ্ড। শুধু আমরা দুজন আমাদের রুমে বসে সুখ-দুঃখের আলাপ করছি। দুলালকে বন্ধু হিসেবে আমি যতটুকু জানি সে খুব কঠিন মানুষ। আবেগের কোন পাত্তা নেই তার কাছে। দুপুর রাত। আমার ধারণা দুলাল ভুল প্রমাণ করল। দুলাল হঠাৎ কান্না করে দিল। তার মা কথা খুব নাকি মনে পড়ছে। আমি কি করব বুঝতে পেলাম না। কিছুক্ষণ পর দুলালের কান্না থামল। থমথমে একটা পরিবেশ সৃষ্টি হলো রুমের মধ্যে। আমি বেসুরো গলায় একটা গান ধরলাম। গান শুনে নিচে থেকে সবাই ছুটে এলো আমাদের রুমে। হুড়োহুড়ি করে দুজনকে টেনে নিয়ে গেল। সিটিং রুমে হৈ হৈ ব্যাপার। শেষ রাত্রের দিকে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙ্গল দুপুর বেলায়। বিছানা থেকে উঠে দেখি, দুলাল তার ব্যাগ গুছাচ্ছে। আমি হতবম্ভ হয়ে বললাম, কারণ কী? দুলাল বলল, আমার একটা চাকরি হয়েছে বার্মিংহাম। চলে যাচ্ছি। তুই কি বলিস? আমি কোন কথা বললাম না। দুলাল ব্যাগ তার বিছানায় রেখে আমার পাশে ক্ষাণিকক্ষণ বসল। হঠাৎ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, নাহ্ যাব না। সত্যি সত্যিই দুলাল গেল না। 
বিকেল বেলার দৃশ্য। দুলাল শুয়ে আছে বিছানায়। আমি বাইরে থেকে এসে তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। এই মুহূর্তে দুলাল কী ভাবছে তা বুঝা বা দেখার সময় নাই। আমি ব্যাগ গুছিয়ে চলছি। হঠাৎ কী মনে হলো দুলালের দিকে তাকালাম। দেখি সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়ত ভাবছে আমি স্বার্থপর। আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম না। মাথায় হাত রাখলাম না। শান্তনার কথাও কিছু বললাম না।
আমি খুব আবেগী মানুষ। ব্যাথায় বুক দুমরে মুচরে ভেঙ্গে যায়। চোখে জল ঝরে অঝোরে। কিন্তু তা সবার সামনে নয়। ব্যাথা অভিমান হলো হৃদয়ের অতি গোপনিয় ব্যাপার। যেখানে কেউ হাত বুলোতে পারে না। কয়েক ফোঁটা রক্তের বিনিময়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয়। সে জল ঝরাতে হয় অতী গোপনভাবে। হাতে সময় নেই। চলে যাচ্ছি এক নতুন ঠিকানায়। চিংফোর্ডে। রিসোর্ট কম্পানিতে চাকরি হয়েছে।
এক রাত্রের কথা কখনো ভুলব না।
চিংফোর্ডে যেখানে স্টাফরা যারা থাকে সে ঘরটা বেশ জঙ্গলের ভিতরে। মনে আছে সেদিন দোল-পূর্ণিমা। বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে কিছু গাছে ফুল ফুঠেছে। আমি নিজের ঘরে টেবিলে আলো জ্বালিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত রিসোর্ট কম্পানির কাজ করছিলাম। কাজ শেষ হতেই ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি, রাত প্রায় একটা বাজে। শীতে জমে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে উকি মেরে মুগ্ধ বিস্মিত হয়ে দাঁড়ায়ে রইলাম। পূর্ণিমার নিশীতিনীর অবর্ণনীয় জোছনা আমাকে মুগ্ধ করল। প্রচণ্ড শীত বলে লন্ডনে গভীর রাতে কখনো বাইরে বের হয়নি। লন্ডনের চিংফোর্ডে পরিপূর্ণ জোছনা-রাত্রির রূপ এই আমি প্রথম দেখলাম। দরজা খুলে বাইরে এসে দাড়ালাম। কেউ কোথাও নেই। নিঃশব্দ, জঙ্গল আর জঙ্গল, নিস্তব্ধ জনহীন নিশীথ রাত্রি। সে জোছনা রাত্রির বর্ণনা নেই। কখনো সে রকম ছায়াবিহীন জোছনা জীবনে দেখি নাই।
ছোট খাটো অনেক আপেল গাছ। এতে তেমন কোন ছায়া হয় না। আপেল জঙ্গলে জোছনা কেমন যেন এক অপার্থিব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। যা দেখলে মনে কেমন যেন ভয় হয়। মন হু হু করে উঠে। নিরব নিশীথরাত্রে জোছনা ভরা আকাশের নিচে দাড়িয়ে মনে হলো এক অজানা রাজ্যে এসে পড়েছি। সে রূপ সৌন্দর্য লোকের সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয় না হলে শুধু কানে শুনে বা লেখা পড়ে তা উপলব্ধি করা যাবে না। মুক্ত আকাশ আপেল বাগান, নিস্তব্ধতা অমন নির্জনতা জীবনে একবার হলেও এমন জোছনা রাতে দেখা উচিৎ। যে না দেখছে, আল্লাহর সৃষ্টির একটি অপূর্ব রূপ তার নিকট চির অপরিচিত রয়ে গেল।


The End

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা