একজন রিক্সা-ওয়ালা

                      একজন রিক্সা-ওয়ালা 

রিক্সা চালাই। বিয়ে করেছিলাম..
আজ থেকে এক বছর আগে। আমার মতই এক গরীবের মেয়েকে বউ করে এনেছিলাম আমি।
অভাবের সংসারটা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়েছিলো ও। বুঝতে পারি বউ আমায় খুব ভালোবাসে। আমি যখন রিক্সা নিয়ে বাড়ি ফিরি ও আমার গোসলের জন্য পানি তুলে দেয়। মাঝেমাঝে আমিও অবশ্য তুলে দেই। বাড়িতে কারেন্ট নেই, খেতে বসলে ও পাখা দিয়ে বাতাস করে। গরমের রাতে দুজনে অদল বদল করে পাখা দিয়ে বাতাস করি, ভবিষ্যৎটাকে সাজানোর গল্প করি দুজনে। গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে যেতাম বুঝতে পারতামনা।
রিক্সায় বড়বড় সাহেবরা তাদের বউকে নিয়ে উঠতো। দুজনে মিলে অনেক গল্প করতো। সাহেবদের কাছে শুনতাম তারা যেদিন বিয়ে করেছে সেদিন আসলে তারা নাকি অনুষ্ঠান, পার্টি না কি জানি করে । এই সব আমার জানা নেই। যখন শুনতাম আমার ও ইচ্ছে করত বউকে একটা শাড়ী কিনে দিতে। বউকে যে খুব ভালোবাসি আমি। কিন্তু পারিনা। অভাবের সংসার, দিন আনি দিন খাই। তাই একটা মাটির ব্যাংক কিনেছিলাম। ওটাতে রোজ দু'চার টাকা করে ফেলতাম। দেখতে দেখতে অভাবের সংসারে আজ একটা বছর হয়ে গেল।
আজ সকালে রিক্সা নিয়ে বের হবার আগে বউ যখন রান্না ঘরে গেল তখন বউকে না জানিয়ে লুকিয়ে রাখা মাটির ব্যাংকটা বের করে ভেঙ্গে দেখলাম সেখানে প্রায় ৪৮০ টাকা হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হবার আগে বউকে বলেছিলাম, আজ বাড়িতে ফিরতে দেরী হবে। বউ মাথা নাড়ে, বলে ভালো করে যাবে। চলে গেলাম রিকশা নিয়ে। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে সন্ধ্যা সাতটায় মার্কেটে গিয়েছিলাম বউয়ের জন্যে একটা শাড়ী কেনার জন্য। আজরাতে বউকে দেবো। ঘুরে ঘুরে অনেক শাড়ীই দেখছিলাম, পছন্দ হয় কিন্তু দামের জন্য বলতে পারিনা। অবশেষে দোকানীকে বললাম,
--ভাই এই কাপড়টার দাম কত ?
--১৫০০ টাকা।
আমার কাছে তো আছে মাত্র ৪৮০ টাকা। তাই ফিরে আসলাম। মার্কেট থেকে বের হয়ে বাইরে বসে থাকা দোকানদারদের থেকে ৪৮০ টাকায় একটা শাড়ী কিনে নিয়ে বাড়িতে চলে আসি। মাঝেমধ্যে ভাবি, এই দোকান গুলো যদি না থাকত, তাহলে কত কষ্ট হত আমাদের মত গরিবদের। ফুরফুরে মেজাজে বাড়িতে ঢুকলাম। অনেকদিন পর বউকে কিছু একটা দিতে পারবো, ভাবতেই বুকটা খুশিতে ভরে উঠছে বারবার।
রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পরার ভান করে শুয়ে আছি। বারটা বাজার অপেক্ষায় চোখ বন্ধ করে আছি। কল্পনার জগতে ভাসছিলাম, বউকে দেবার পর বউ কি বলবে ? কতটা খুশি হবে ? রাত বারটা বেজে গেল। বউকে ডেকে তুললাম। ডেকে তুলে বউয়ের হাতে শাড়ীটা তুলে দিয়ে বললাম, আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। আজকের তারিখে তুমি আমার এই কুড়ে ঘরটাতে এসেছিলে। আমার পক্ষথেকে তোমার জন্য এই ছোট্ট উপহার।



বউ শাড়িটা বুকে জড়িয়ে, চোখ দিয়ে জল ঝরতে থাকে ওর। তারপর উঠে গিয়ে ট্রাংটা খুলে শাড়িটা রেখে দেয়। তারপর কি যেন বের করে। আমি উকি মেরে দেখার চেষ্টা করেও দেখতে পাইনা। বউ ট্রাংটা বন্ধ করে আমার হাতে একটা প্যান্ট দিল।কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম আমি। কারণ টাকা পেল কোথায় ?
জিজ্ঞাসা করলাম,
--টাকা পেলে কোথায় তুমি ?
--অনেকদিন আগে থেকে প্রত্যেকদিন একমুঠ করে চাল খাবারের চাল থেকে আলাদা করে
জমিয়ে রাখতাম। জমিয়ে জমিয়ে কিছুদিন আগে পাশের বাড়ির ভাবির কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। সেই টাকা দিয়ে প্যান্ট কিনেছি। ভাবছিলাম আজকে দেবো, তুমি তো এসেই ঘুমিয়ে পরলে। তাই ঠিক করছিলাম কাল সকালে দেবো। আমি কিছু বলতে পারলামনা। শুধু প্যান্ট টা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিলাম।
তারপর বললাম, শুনেছি বড় সাহেবরা নাকি বিয়ের দিন তারিখে কেক কাটে।
বউ বলে, আমাদের কি এতো টাকা আছে ?
--বাড়িতে মুড়ি আছে।
--আছে।
--যাও সরিষার তেল দিয়ে মুড়ি নিয়ে এসো। সাথে একটা কাঁচা লঙ্কা আর একটা পিঁয়াজ এনো।
--আচ্ছা দাঁড়াও আনছি।
টিনের ফাঁক আর জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। দুজন জানালার পাশে বসে মুড়ি খাচ্ছি, আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী পালন করছি।


_ 


ছোট ছোট গিফট আর অফুরন্ত ভালোবাসায় বেঁচে থাকুক সারাজীবন ।
বেঁচে থাকুক আমাদের সবার জীবনে এই রকম ভালোবাসা। সুখী হতে বেশি কিছুর দরকার নেই। এই টুকু ভালোবাসা, সম্মান, বিশ্বাস, যত্ন, সুন্দর একটা মনের ভালোবাসা হলেই সুখী হওয়া যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা