নিকোলা টেসলা

 

নিকোলা টেসলা 

ভুল সময়ে জন্মানো ভয়ংকর মেধাবী বিজ্ঞানী: নিকোলা টেসলা একজন মহান কিংবদন্তী!

নিকোলা টেসলা ১৮৫৬ সালের ১০ ই জুলাই তৎকালীন অস্ট্রীয় সাম্রাজ্যের স্মিলিয়ান অর্থ্যাৎ বর্তমান ক্রোয়েশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

টেসলার বাবা মিলুতিন টেসলাও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বিষয়ক জ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। এমন কি তিনি তাদের পূর্বপুরুষ পশ্চিম সাইবেরিয়ানদের "সাইবেরিয়ান মহাকাব্য" ও মুখস্ত রাখতে পারতেন। আর টেসলার মা ডুকা টেসলারও স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ! আর তাদেরই সন্তান নিকোলা টেসলার মেধার পরিমাণ কেমন ছিল এবং সেই মেধার ফলস্বরুপ বিশ্বজগত কিভাবে উপকৃত হয়েছে এবং কিভাবে তিনি সারা বিশ্বে তার আবিষ্কারের মাধ্যমে অমর হয়ে আছেন তার গল্পই বলবো আজ!

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। জন্মের পর থেকে বড় হতে হতে মায়ের পরিচর্যা আর বংশগত কারণেই হয়তো বাবা - মায়ের মেধা এবং অবশ্যই অবশ্যই সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত নিজের অসাধারণ কিংবা তার চেয়েও বেশী "ভয়ংকর মেধা" নিয়ে বড় হতে লাগলেন টেসলা। 'ভয়ংকর' কেন বললাম? না বলে উপায় আছে? যেমন আশ্চর্য এবং অতিরিক্ত মেধা সৃষ্টিকর্তা তাকে দিয়েছেন সেই মেধাকে আর কি বলে সংজ্ঞায়িত করা যায় আমার জানা নেই!

নিকোলা টেসলা ১৮৬১ সালে প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হলেন। সেখানেই শিখলেন জার্মান, গণিত ও ধর্মতত্ত্ব! ও হ্যা, এখানটায় একটা কথা বলে রাখা জরুরী... টেসলার বাবা ও নানা দুজনেই ছিলেন ধর্মযাজক। তাই তার বাবা চাইতেন তিনিও ধর্মযাজক হন । কিন্তু নিকোলার ইচ্ছে ছিল তিনি পড়াশুনো করবেন!

১৮৭০ সালে তিনি উত্তরের কারলোভাকে একটি হাইস্কুলে ভর্তি হন। তখন তার বয়স সবে চৌদ্দের ঘরে পা রেখেছে। সেখানে একজন ইন্টিগ্রেশনের টিচার তার মেধা বুঝতে পারেন! টেসলা ছিলেন এমনই একজন যিনি যেকোনো কঠিন অঙ্ক জীবনে প্রথমবার শুনেও মনে মনে সমাধান করে ফেলতেন... মনে মনে ক্যালকুলাসের নানাবিধ সমস্যার সমাধান বের করে শিক্ষকদের বিস্ময়ে হতবাক এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিতেন! যিনি হাজার হাজার ডিজাইন কেবল মাথার মধ্যে করে রাখতে পারতেন। এমনও জনশ্রুতি আছে, গবেষণার বিষয়ে কোনোদিন হাতে লিখতেন না... আঁকতেন না! পৃথিবীর খুব কম মানুষেরই ফটোগ্রাফিক মেমোরী থাকে... টেসলা ছিলেন এমনই একজন। পরবর্তীতে টেসলারই কোনো সাক্ষাৎকারে জানা যায়, একজন পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপকের মাধ্যমে তিনি তড়িৎ প্রদর্শনী তে উৎসাহী হয়ে ওঠেন! সেইসব প্রদর্শনীতেই দারূণ দারূণ রহস্যময় সব ঘটনার কারণে তিনি বিদ্যুৎ এর উপর আকৃষ্ট হন এবং বিদ্যুৎ এর মতো এক অসাধারণ শক্তি সম্পর্কে জানতে পারেন।

১৮৭৪ সালে তিনি সেনাবাহিনীতেও যোগ দেন.. সেইসময়ে খুব প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতেন! তিনি তখন পাহাড় - পর্বতের খুব কাছাকাছি ছিলেন বলেই হয়তো মানসিক প্রশান্তিতে ছিলেন!

টেসলা বলতেন - প্রকৃতি তাকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে শক্তিশালী করেছে। সেই সময়ে সেখানে মার্ক টোয়েন ও ছিলেন। হ্যা ছোটরা যাকে হাকলবেরী ফিন এবং টম সয়্যারের জন্য চেনে সেই মার্ক টোয়েন... মার্ক টোয়েন ভারী মজার মানুষ ছিলেন!

টেসলা নিজেও বলেছেন -- মার্ক টোয়েনের সাথে কাজ করায় তার প্রাথমিক অসুস্থতা দূর হয়েছিলো! সেনাবাহিনীতেও তিনি ভালোভাবেই সফল হন।


টেসলা বিজ্ঞান বিভাগেও মেধাতালিকায় প্রথম থাকতেন। এবং টেসলা জানায়, তিনি সপ্তাহে দুইদিন ছাড়া বাকিসব দিন ভোর তিনটা থেকে রাত এগারোটা অবধি পড়াশোনা করতেন! আসলে টেসলার যেমনি অসাধারণ মেধা ছিল... তেমনি সমান তালে তার পরিশ্রমও ছিল। তিনি পরিশ্রমী হতে শিখেছেন তার বাবার কাছ থেকেই! যদিও তার বাবা নিজেও ছেলের এমন পরিশ্রমের জন্য সবসময় ছেলের দুশ্চিন্তায় ভয়ে থাকতেন।

তবে সবসময় যে টেসলা খুব মনোযোগী ছিলেন এমনও নয়... এমনও হয়েছে যখন তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ বর্ষ ছিল... অথচ তিনি ছিলেন উদাসীন এবং ভবঘুরে!

মজার ছলে বলা যায়, বিজ্ঞানী তো একটু আধটু ভবঘুরে আর উদাসীন না হলে হয় নাকি? তারা যেন মনের ইচ্ছেতে খেয়ালী রাজপুত্রের মতো মনের ডায়েরীতে আঁকিবুকি করে গবেষণা করেন! আহা...

টেসলা যেসব ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন...

১৮৯১ সালের ৩০ শে জুলাই টেসলার বয়স যখন ৩৫ তিনি আমেরিকার নাগরিকত্ব পান এবং নিউওয়ের্কে একটি গবেষণাগার তৈরী করেন। সেখানে তিনি তারবিহীন পাওয়ারফুল ট্রান্সমিশন তৈরী করেন এবং একই বছরেই 'টেসলা কয়েল' উদ্ভাবন করেন! টেসলা কয়েলে প্রাইমারী এবং সেকেন্ডারী নামে দুটি কয়েল থাকে এবং প্রতি কয়েল ভিন্ন ভিন্ন ক্যাপাসিটর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। দুটি কয়েলে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিমাণ "স্পার্ক গ্যাপ" থাকে!

এই কয়েল উচ্চশক্তির উৎস এবং ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে শক্তি সরবরাহ করা হয়!

এছাড়াও তিনি এক্স - রে নিয়েও কাজ করেন।

পরবর্তীতে টেসলার থিওরির উপর ভিত্তি করে রেডিও, রাডার তৈরী করা হয়।

হাইড্রোলেক্টিসিটির প্রথম ধারনা দিয়েছিলেন টেসলা। ট্রানজিস্টর বানানোর জন্য কোন কোন ইলিমেন্টস লাগবে টেসলাই বলেছিলেন! যেটা ছাড়া কম্পিউটারই আসতো না। রেজুনেন্ট ফ্রিকোয়েন্সী, ইলেক্ট্রিক মোটর, রিমোট কন্ট্রোল, নিওন লাইট এবং তারবিহীন প্রযুক্তি পর্যন্ত টেসলার আবিষ্কার!

টেসলা একটি ভূমিকম্প যন্ত্রও আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন তিনি চাইলে এমন ভূ - কম্পন তৈরী করতে পারবেন যাতে পুরো মানবজাতিই শেষ হয়ে যেতে পারে! (যদিও সেটা ভুল করেই তৈরী করে ফেলেছিলেন।) তিনি আরো দাবি করেছিলেন তিনি চাইলে ভূ - কম্পনের মাধ্যমে পৃথিবীকে দু' ভাগে স্লাইস করতে পারবেন!

নিকোলা টেসলার ওয়্যারলেস ইলেক্ট্রিসিটির কাজ তিনি পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে শেষ করতে পারেননি, তিনি যদি সেই প্রজেক্ট টা শেষ করতে পারতেন তাহলে সারা পৃথিবী ফ্রীতেই বিদ্যুৎ সুবিধা পেতে পারতো! যিনি এই প্রজেক্টে ইনভেস্ট করছিলেন তিনি... জেপি মর্গানের একসময় মনে হলো এই প্রজেক্ট ফুলফিল হলে তার অনেক বিদ্যুৎ সরবরাহ করা কোম্পানির ক্ষতি হয়ে যাবে.... তাই তিনি ইনভেস্ট করা বন্ধ করে দেন। আর এভাবেই একটা স্বার্থান্বেষী ভাবনার জন্যই এতো বড় একটা সুযোগ থেকে পৃথিবী বঞ্চিত হলো! এছাড়াও, উনি একটি ইন্টার্ভিউ তে বলেছিলেন তার আবিষ্কৃত "থট ক্যামেরা" সম্পর্কে। তিনি বলেছিলেন তিনি এমন একটু ক্যামেরা বানাতে পারবেন যা মানুষের মনের সকল কল্পনাকে একটা ছবিতে রূপ দেবে। টেসলার ভাষ্যমতে, মানুষের কল্পনার হুবহু রিফ্লেকশন রেটিনায় পরে। আর সেখান থেকে সেই ক্যামেরা দিয়েই মানুষ ক্যামেরা চোখের সামনে ধরে নিজের কল্পনাকে মুহূর্তেই হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে পারতো। এমন হলে কোনো মানুষের কল্পনায়ই বিদ্যুৎ গতিতে এসে সেখানের অনেক চিন্তাই সাব -কনসাশ মাইন্ডের গভীরে হারিয়ে যেতো না... সবাই নিজেদের সব কল্পনায়ই ছবির মতো দেখতে পেতো! কিন্তু উনি এই কাজটাও শেষ করতে পারেননি, শেষ করার আগেই তার মৃত্যু হয়। টেসলা সেইসময়ে যেই আবিষ্কার প্রায় করেই ফেলেছিলেন সেই একই আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে বর্তমান সময়ের অনেক বিজ্ঞানী মাইন্ড রিডিং নিয়ে রিসার্চ করছেন। টেসলা সময়ের তুলনায় অনেক অনেক এগিয়ে ছিলেন... এই কারণেই তাকে "ম্যান অব দ্যা ফিউচার" বলা হতো!

এতো কিছুর পরেও, তার থিওরি অনুসারে কাজ করে অন্য বিজ্ঞানীরা নোবেল প্রাইজ পেলেও তিনি কিন্তু কখনোই নোবেল প্রাইজ পাননি!

তবে তার আবিষ্কৃত এককের নাম রাখা হয় টেসলা ; আর ১০ জুলাই তার সম্মানে টেসলা দিবস পালিত হয়।

১৯৪৩ সালের ৭ ই জানুয়ারী নিকোলা টেসলা মৃতুবরণ করেন। প্রথমেই টেসলার ভুল সময়ে জন্মানোর কথা বলেছিলাম.... বলেছিলাম কারণ সেই সময়ের নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সঠিক মূল্যায়ন কিংবা অর্থের কারণেও তার অনেক আবিষ্কারের স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিলো। তবে অনেক আবিষ্কারই তিনি রেখে গেছেন পৃথিবীতে... পৃথিবীর মানুষ যতদিন তার থিওরি এবং আবিষ্কার ব্যবহার করবে ততদিন তিনি তার আবিষ্কারের মাধ্যমে অমর হয়ে থাকবেন... চিরকাল।

টেসলা আসলেই ছিলেন সময় থেকে অনেক অনেক এগিয়ে থাকা ভুল সময়ে জন্মানো ভয়ংকর মেধাবী একজন কিংবদন্তী!

 

তথ্য সুত্রঃ Quara- N.T.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা