আমি মা হয়েছি

 

আমি মা হয়েছি


আমি কোনদিনও মা হতে পারব না জেনেও এক ভদ্রলোক আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন...!
সে আমাকে দয়া করছে নাকি নিজের প্রয়োজনে বিয়ে করতে যাচ্ছে তা জানা আমার পরিবারের জন্য এখন মূখ্য নয়... আমার বিয়ে হবে আগামী মাসে এটাই আমার পরিবারের জন্য সুখবর l
এই সুসংবাদে দিদা দুইজন ব্রাহ্মণকে খাইয়েছেন l  যদিও তিনি ভয়াবহ কৃপণ ভিখারিকে ভিক্ষা দেওয়ার সময়ও দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলেন, "যাও কাজ করে খাও l আমার নাতি কষ্ট করে রোজগার করে তোমাদের জন্য.?" সেই ভিখারি অসহায় ভঙ্গিতে বলে ফেলে "চোখে দেখি না কাজ করবো কী করে ? আমাকে অকারণে বকছেন !
বড় দাদা হাসি হাসি মুখে আমার ঘরে আসে তার হাতে কোয়ালিটি আইসক্রিম দাদা জানে আইসক্রিম আমার পছন্দ l আজই সব ফাইনাল হয়েছে ছেলে দাদার পরিচিত l দাদার ফর্সা মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হচ্ছে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দাদা আমার মাথায় হাত রেখে মৃদু স্বরে বলেন l
-- বুঝেছিস অপর্না তোর লাক ভালো জেনে বুঝে কেউ এত বড় স্যাক্রিফাইজ করে না l
আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি, সত্যিই সৌভাগ্য আমার - আমার বিয়ের সাথে সাথে আমি একটা মেয়েও পেয়ে যাচ্ছি l
ক্লাস ফোরে পড়ুয়া মেয়ে তবে আমাদের মেয়ে নয় ভদ্রলোকের একার মেয়ে l আমি আইসক্রিম হাতে নিয়ে জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়াই আইসক্রিম গলতে থাকে আর আমি দেখতে থাকি--পিচঢালা রাস্তা l হুড খোলা রিকশা বাতাসে হেলেদুলে উঠা নারকেল গাছের ডাল ডালে ডালে ঘষা খেয়ে কেমন খস খস আওয়াজ হয় -আমার বুকের ভেতরেও l মা খুশি তবুও মায়ের মুখের দিকে তাকালে আমি অপরাধবোধ দেখতে পাই একটা সন্তান আমার কোলে আসার আগেই কোল খালি করার অপরাধ l কখনো কখনো আমার ঘরে এসে আমার মাথায় তেল দেওয়ার বাহানায় নিজের অপরাধ স্বীকার করেন কাঁপা গলায় বলেন "সব আমার দোষ l আমি অবশ্য কাউকে দোষ দিই না সব দোষ নিয়তির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে স্বস্তি খুঁজি...
আমি আলমারির উপরে রাখা বার্বি ডল দেখি গোলাপি রঙের জামা পরা কেমন টানাটানা গোল গোল চোখ এক সময় পুতুল খেলতাম খুব l পুতুলের বিয়ে দিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতাম এসব কান্নাকাটি এখন ভুলে গেছি জল যদি জমে বরফ হতে পারে কান্না জমে কঠিন কেন হবে না ? বছর চার আগেই সে কান্না কঠিন স্ফটিক হয়েছে ডা.অলোক রায় যেদিন মাকে কঠিন গলায় বলেছিলেন "আপনার মেয়ের এই সর্বনাশের জন্য আপনিই দায়ী l ঠিক সেদিন থেকেই আমি হাজার চেষ্টা করেও কাঁদতে পারতাম না অস্থির লাগত গলায় কান্না দলা পেকে বসে থাকত বিশাল পাথর বুকে চাপিয়ে রাখলে যেমন দম বন্ধ বন্ধ হয়ে আসে ঠিক তেমন l
সেদিন ছিল ঝলমলে রৌদ্রজ্বল দিন কোকিল তালে তালে পাতার ফাঁকে ডেকেই যাচ্ছে, আমি ডা. অলোক রায়ের চেম্বারে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি l তিনি ট্রান্স ভ্যাজাইনাল আলট্রাসনোগ্রামের রিপোর্ট গম্ভীর মুখে উল্টে পাল্টে দেখছেন l আমি কোকিলের ডাক শুনছি খানিক বাদেই তিনি পাওয়ার ওয়ালা চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন l ভদ্রলোক কলম ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন "এর আগে আর কোন গাইনোকলোজিস্টের সাথে কনসাল্ট করেননি ?
মা ছোট্ট করে উত্তর দেয় "না"...
ডাক্তার স্থির চোখে আমার দিকে তাকালেন তারপর আস্তে আস্তে বলা শুরু করলেন "ওর হয়েছে পেলভিক ইনফ্লামিটরি ডিডিজ সহজ কথায় ডিম্বনালীতে ক্ষত l দীর্ঘদিন পিরিয়ডের প্রবলেম নিয়ে মেয়েকে বসিয়ে রেখেছেন পেটের যন্ত্রণা কমাতে লং টাইম খাইয়েছেন নন স্টেরয়ডাল এন্টি ইনফ্লামিটরি ড্রাগ l এই তীব্র ব্যথানাশক ওষুধ গুলো সাময়িক ভাবে ব্যথা কমালেও কিছু ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে ক্ষতি করে দেয় l তার উপর একটা অবিবাহিত মেয়েকে ওরাল কন্ট্রাসেপটিভও দিয়েছেন পিরিয়ড নিয়মিত করতে l হোয়াট ইজ দিস ?


সেটাই ওর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিম্বনালী এখন বন্ধ হয়ে গেছে অপারেশন ছাড়া উপায় নেই l ডা.অলোক রায় গলা চড়া করে বললেন "এই মাতব্বরি আপনাকে কে করতে বলেছিল বলুন তো ? এই অপারেশনের পর যদি মা হওয়ার ক্ষমতা হারায় দয়া করে আমাদের উপর দোষ চাপাবেন না l এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন যখন ক্ষত ছড়িয়ে গেছে ব্যাপক ভাবে l ভদ্রলোক কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে গেলেন লাল টকটকে গাল আর অগ্নিদৃষ্টি l হয়ত তার ভেতরে প্রচন্ড খারাপ লাগা শুরু হয়েছে একটা ২০ বছরের তরুণীর জন্য এই তরুণীরা কত স্বপ্ন দেখে l একদিন টানা করে কাজল দিয়ে, হাতে ভারী চুড়ি,টকটকে লিপস্টিক,বেনারসি পরে স্বামীর বাড়ি যাবে l তারপর একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে হাসবে, কাঁদবে, মুগ্ধ হবে l তার পেটের উপর হাত রেখে কাউকে স্বাগত জানাবে আচারের বয়াম নিয়ে বসবে তারপর কোলজুড়ে একটা মোমের পুতুল আসবে l বাস্তব পুতুল, যে পুতুলের দিকে তাকালে যন্ত্রণা সব উধাও হয়ে যাবে l আর আমার বেলায় হয়েছে উল্টো যন্ত্রণা আঠার মত লেগে বসে আছে l
আমার অপারেশন হল অপারেশন শেষে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসার পর মা আমাকে চোখে চোখে রাখতেন l আমার ঘরের দরজা বন্ধ করলেই মা চেঁচিয়ে উঠতেন "দরজা দিচ্ছিস কেন ? দরজা খোলা রাখবি সব সময় l
আমি হেসে বলতাম " ভয় পেয়ো না মা আমি গলায় দড়ি দেব না l মরণ অত সহজ নাকি ?
কত মানুষ নিজের জীবন ভালোবেসে বেঁচে আছে সেটাই তো উচিত তবে আশ্চর্যজনকভাবে আমি কাঁদতে ভুলে গেলাম l নিজেও ভেবে অবাক হলাম এমন কেন হল l ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখ ঘটা করে সেই ভদ্রলোকের সাথে আমার বিয়ে হল l ঝলমলে চুল, উচ্চতা " কিংবা " হবে বোধ হয় দেখলেই বোঝা যায় ধীর স্থির প্রত্যেকটা কথা বলেন মেপে মেপে l আমি ঘরে ঢুকে দেখলাম তার আগের স্ত্রীর ছবি দেয়ালে টাঙানো মনে হচ্ছে জীবন্ত একটা মানুষকে শুধু শুধু ছবির ফ্রেমে আটকে রাখা হয়েছে l তিনি মারা গেছেন গত ছয় মাস আগে ভদ্রলোক ছবির সামনে দাঁড়িয়ে চশমা খুলে চোখ মোছেন l আহা সম্ভবত স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন "তুমি মরলেও আরেকটা বিয়ে করব না " l পুরুষ জাতির কমন ডায়ালগ কিন্তু প্রয়োজনীয়তা প্রতিজ্ঞা ভুলিয়ে দেয় এটা বাস্তবতা l
অনু আমার কাছে আসেনি আমি একবার ওর ঘরে গিয়ে রেশমের মত চুলে হাত বুলিয়ে বলেছিলাম "চল মামনি তোমাকে খাইয়ে দিই" l অতটুকু মেয়ে কঠিন গলায় বলেছিল, "তুমি এখান থেকে চলে যাও" l আমি চুপচাপ বসেছিলাম মনকে বুঝিয়েছিলাম "সব অপছন্দের নাম ঘৃণা নয়" l কিছু অপছন্দের মানে তার পছন্দের জায়গায় থাকা মানুষকে সরিয়ে সেই স্থানে তোমাকে নিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে l আমি মা হলেও মায়ের আগে একটা সৎ যুক্ত হয়ে মায়ার বাঁধন থেকে ছোট্ট মেয়েটা আমাকে মুক্তি দিতে চাইছে l আর আমি বারবার সেই বাঁধনে মাকড়সার জালের মত আটকা পড়ছি l স্কুলে যাওয়ার সময় জুতোর ফিতে বেঁধে দিতে চাইলে আমার হাত সরিয়ে দেয় l সবজি দিয়ে ভাত খেতে বসলে ভাত নাড়াচাড়া করে আমি সহজ গলায় বলি "ডিম ভাজি করে দেই মামনি ? অনু কথা বলে না এরই মধ্যে অনেকের হাজার বার বলা হয়ে গেছে "আহারে মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গেছে"…. নিজের মা থাকলে কি এমন হত ?
সৎ মা থাকলে কেউ ভালো থাকে ?
হয়ত অনুও তাই ভাবে কোথায় ঘুরতে গেলে সে কখনো আমাদের মাঝে আমাদের দু হাত ধরে হাঁটে না একপাশে গিয়ে হাঁটে ওর বাবার হাত ধরে। হয়ত চায় না- যে হাতে,যে দেহে,যে রক্তে ওর মা মিশে আছেন সেখানে অন্য কেউ আধিপত্য করুক l মাঝরাতে কখনো কখনো ওর ঘরে যাই কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে চুপচাপ চলে আসি। একটু অসুস্থতায় আমি এদিক ওদিক ছুটোছুটি করি সৈকত শুধু সান্ত্বনা দিয়ে বলে এত অস্থির হয়ো না তো অপর্না আমার অস্থিরতা কমে না।

জানালা গলে জ্যোৎস্না আসে সেই জ্যোৎস্নায় কিছু না পাওয়া ভাসে আঁধার বাড়ে,আঁধারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে হাহাকার। মাঝে মাঝে ওর পড়া বুঝিয়ে দিতে খাতা কলম নিয়ে বসি আনমনা হয়ে বসে থাকে মায়ের কথা মনে পড়ে বোধ হয়। অনু আমাদের ঘরে খুব একটা আসে না হয়ত অস্বস্তি লাগে কিংবা আমাকে ঘৃণা করে বলেই আসে না। হঠাৎ কি মনে করে একদিন আমাদের ঘরে এল। আসার আগে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল "আসব" ?
আমি হেসে বললাম হ্যাঁ অবশ্যই এটা তো তোমারই ঘর।
অনু মাথা নিচু করে বলল আমার একটা হোমওয়ার্ক দিয়েছে সব ঠিক আছে কিনা তুমি দেখে দিতে পারবে ?
--- কেন পারব না ?
অবশ্যই পারব দেখি, খাতাটা দাও।
খাতাটা আমার হাতে দিয়ে অনু চুপচাপ খাটে বসে আমি ওর খাতার লেখা পড়তে থাকি মাই মাদার প্যারাগ্রাফ। সে গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছে " মাই মাদার' নেম ইজ অপর্না, শী লাভস মি সো মাচ, আই লাভ হার অলসো।  
আমি জানি এটা ওর হোমওয়ার্কের খাতা নয় সেটার রঙ নীল আমি ওর মুখের দিকে তাকাই ছোট্ট মেয়েটার চোখে ঝরঝর করে জল ঝরছে। কী আশ্চর্য ছোট্ট মানুষ কাঁদবে কেন ? ওরা সারাদিন খলখলিয়ে হাসবে শুধু আমি ওকে টান দিয়ে আমার বুকে চেপে ধরি। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদে আমি বারবার বলতে চাইছি এই বোকা মেয়ে কাঁদছিস কেন এমন করে ?
এমন করে কাঁদলে মায়ের কষ্ট হয় না ?
কী অদ্ভুত আমার গলা দিয়ে কোন কথা বের হয় না...
কত বছর পর আমার জমাট বাঁধা কান্না তরল হয়ে গড়াচ্ছে আমি হিসেব নিকেশ করছি। হিসেব মেলাতে পারছি না আমি মোমের পুতুলটাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরি। আজ সারাদিন জড়িয়ে ধরে রাখব।
আর এই ভাবেই সারাজীবন বুকে আলগে রাখবো। তুই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্পদ...!!!"

 

------------------------------------------------------------------------
“““লেখার মধ্যে ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন„„„ 

গল্পটি কারো অনুরোধে লেখা । সত্য ঘটনার অবলম্বনে ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা