গল্পঃ "জ্বীন প্রতিবেশী" --- পর্বঃ ০৬

গল্পঃ "জ্বীন প্রতিবেশী"

পর্বঃ ০৬ 


লাবনি ইসলাম অনিলার মাথায় এতো তেল দিয়ে দিয়েছেন যে, তার বার বার মনে হচ্ছে ঘাড় আর কানের পাশ দিয়ে তেল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সে একটা টিস্যু দিয়ে মুছতে থাকে।
--"
এতো তেল দিয়েছো না মা! দেখো এখন টপটপ করে কিভাবে পরছে!!
অনিলা মিছে মিছে মায়ের সাথে ঢং করে। লাবনি ইসলাম হাসি দিয়ে কি যেন বলতে যান আর ঠিক তখনি তার মোবাইল টা বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠে "অনিলার বাবা"
তিনি ফোনটা হাতে নিয়ে নিজের রুমে চলে যান।
অনিলা ভাবে সেও বাবার সাথে কথা বলবে।কিছুদিন যাবৎ বাবার সাথে কথা হয়নি তার। মায়ের কাছ থেকেই বাবার খবর নিয়েছে এই কয়েকটা দিন।
অনিলা তার বাবাকে খুব কমই কাছে পেয়েছে।তার যখন চার মাস বয়স তখনি আশরাফ হোসেন বিদেশ পাড়ি জমান। তার পর প্রথমবার যখন আসেন তখন অনিলার বয়স
সাত ছুঁই ছুঁই করছে। বাবার সাথে ফোনেই যতো অাল্হাদ করতো সে।
তার মনে আছে, বাবা যখন প্রথম বিদেশ থেকে আসেন, সেদিন সে বাবার সাথে অভিমান করে কথা বলেনি। কারণ এতো বছর পর তার বাবা তাকে দেখতে এসেছে!এতোদিন অাসেনি।
অনিলার সব সময় মনে হয়েছে, তার বাবার কাছ থেকে সে ঠিক যতটা ভালোবাসা পাওয়ার কথা তার একমাত্র সন্তান হিসেবে, সে ততো টা কখনোই পায়নি। এটা নিয়ে তার মনে তীব্র কষ্ট লুকিয়ে থাকলেও অনিলা সেটা কখনোই প্রকাশ করেনি।
কিন্তু একটা ব্যাপার সে সব সময় খেয়াল করেছে, তার বাবা তাকে যেমনি ভালোবাসুক না কেনো, অনিলার মায়ের প্রতি তার বাবার ভালোবাসা সীমাহীন। হাজার হাজার মাইলের দুরত্বও কখনো তাদের স্বামী, স্ত্রীর ভালবাসার মাঝে পঁচিশ বছরেও কোন দাগ ফেলতে পারেনি।
অনিলা এতেই খুশি!
লাবনি ইসলাম তার প্রিয় রকিং চেয়ারে বসে হাসবেন্ডের কল রিসিভ করেন। সালাম দিয়ে কথা শুরু করেন তিনি।
--"
কি দিয়ে নাস্তা করেছো লাবু?"
আশরাফ হোসেন লাবনি কে আদর করে লাবু বলে ডাকেন। কিন্তু লাবনির এই ডাক শুনলেই রাগ লাগে। কেমন লেবু লেবু শোনা যায়! অসহ্য!
--"অনেক কিছু দিয়ে। আজকে তোমার মেয়ে নাস্তা বানিয়েছে। যা টেস্টি ছিলোনা খাবারটা!
--"
লাবনি, তোমাকে না কতোবার বলেছি ওকে আমার মেয়ে বলবে না। এই মেয়ে আমার সন্তান নয়। কোথেকে এনেছো, কে দিয়েছে তোমাকে কখনোই বলনি অামাকে তুমি। যত বার জানতে চেয়েছি তোমার ভালোবাসার দোহাই দিয়ে এড়িয়ে গেছো। এই মেয়ের কারনে আমরা দুজন স্বামি স্ত্রী হয়েও একসাথে সংসার করতে পারছিনা। না তুমি আমার কাছে আসতে পারছো, না আমি দেশে এসে থাকতে পারছি! দু বছর পর পর এসে পনেরো বিশ দিন
থাকাকে সংসার করা বলেনা লাবনি!"
লাবনি ইসলাম একটা কথাও বলেন না। তার চোখে পানি ছল ছল করে। গলা ভারী হয়ে আসছে তার। আশরাফ হোসেন আর কিছু না বলে লাইন কেটে দেন।
লাবনি ইসলাম চেয়ার দোলাতে দোলাতে সিলিং এর দিকে চেয়ে থাকেন। তিনি খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারেন, অনিলার দায়িত্ব নিতে গিয়ে তিনি স্বামী কে ঠকিয়েছেন।
কিন্তু লাবনি এটা এক বাক্যে স্বীকার করেন আশরাফ হোসেনের জায়গায় অন্য কেউ হলে কখনোই অনিলা কে এভাবে মেনে নিতনা।লাবনির সাথেও হয়তো কোন সম্পর্ক থাকতোনা।কে মানতো, এক রাতের মধ্যে চল্লিশ দিনের পরিচয় না জানা একটা বাচ্চাকে নিজের সন্তানের স্বীকৃতি দিতে? তাও শুধু মাত্র তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে! হয়তো কেউ দিতো, লাবনির জানা নেই।
অনিলা জানে, মা যখন ছুটির দিনে বাবার ফোন রিসিভ করে, তখন কমসে কম এক ঘন্টাতো লাগেই তাদের আলাপ শেষ হতে!
সে ভাবে এর ফাকে একবার একটু আফসানাদের বাসায় যেয়ে আসা যাক। মা টের পাবেনা। সে মায়ের রুমের দিকে তাকিয়ে দেখে দরজা লক করা।
নিজেকে এক নজর আয়নায় দেখে নেয় অনিলা। নাহ,যতই তেলে চপচপ করুক তার চুল, এতে করে তার চেহারা একটুও মলিন হয়নি। সে একটা ওড়না মাথায় দিয়ে বের হয়।
আফসানা দের বাসার দড়জা লাগানো। অনিলা কয়েক বার নক করে। কারো টু শব্দটিও নেই। অনিলার মন টা খুব খারাপ হয়ে যায়।


খুব রাগ লাগে তার আহামদের উপর। কেনো তারা দরজা খুলছেনা। নাকি বাসায় কেউ নেই ?
অনিলা নিচে নামতে যায়, ঠিক তখনি আফসানাদের ফ্লাটের দরজা খোলার শব্দ আসে। অনিলা দাড়িয়ে যায়। আহমাদ দরজা খুলে। অনিলার সাথে চোখাচোখি হয় তার। সালাম দিয়ে মুচকি হাসি দেয় সে।
অনিলার হার্টবিট খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। তার মনে হয়, না আসলেই ভালো হতো!!
অনিলা খুব ধীরে সালামের উত্তর নেয়। তার কেনো জানি খুব লজ্জা লাগছে!!
-- "আপনি বোধহয় আফসানার কাছে এসেছেন।আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি। আপনি ভেতরে এসে বসুন।"
আহমাদ দরজার সামনে থেকে সরে দাড়িয়ে অনিলাকে ভেতরে ঢোকার পথ করে দিলো। অনিলার মনে হলো, এই বুঝি আহমাদের গায়ের সাথে ধাক্কা খেলো সে! আহমাদ অনিলাকে বসতে বলে ভেতরে চলে যায়।
আফসানা আর তাদের চাচা রাশিদ বেগ থমথমে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহমাদ তাদের কাছে যেয়ে দাড়ালো।
--"
ভাইজান,আপনি এটা একদমই ঠিক করছেন না। আপনি আজও "উনার" সাথে দেখা দিয়েছেন। আফসানা অনেকটা রাগী কন্ঠে ভাইকে বলে।
--"
এমন করা তোমার একদমই ঠিক হচ্ছেনা আহমাদ বেটা।"
আফসানার সাথে সুর মেলালো চাচা রাশিদ বেগ।
--"
কোন সমস্যা হবেনা চাচাজান।অাপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন।দাদজান বা অাব্বুজান কিছুই জানবেনা।"
--"
ভাইজান, আর কয়েকটা দিনইতো বাকি ছিলো।আপনি একটু ধৈর্য ধরতে পারলেন না!জানেনইতো, আমাদের সমাজে এসব কিছু গোপন রাখা খুবই কষ্টকর। একবার যদি একথা কেউ জেনে যায় যে, তাদের জ্বীন সমাজের প্রধানের একমাত্র ছেলে নিয়ম ভংগ করেছে, যে কিনা পরবর্তীতে জ্বীন সমাজের প্রধাণ হওয়ার দাবিদার। তাহলে অাব্বু জানের প্রাধান্য তো যাবেই সাথে আপনিও আর সমাজ প্রধাণ হতে পারবেন না।
আপনি কি ভুলে গেছেন, সাবরিন ফুফুজানের কারনে দাদাজান কতটা অপমানিতো হয়েছিলো আমাদের সমাজে। দাদা জানের প্রাধান্য ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিলো ফুফুজানের ভুলের কারনে।কতটা অপমানিত করা হয়েছে আমাদের।"
বোনের কথা শুনে আহমাদের প্রায় আঠারো বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়। বেশিদিন হয়নি সেই কাহিনীর।
আহমাদের দাদা সোলায়মান বেগের একজনই সন্তান হয়। সে হচ্ছে অাহমাদ বেগের বাবা সালমান বেগ। তার দাদা সোলায়মান বেগ তখন জ্বীন সমাজের মধ্যে খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাদের অঞ্চলের প্রধাণ।
একদিন ইয়ামেন রাজ্য থেকে সেখানকার জ্বীন প্রধাণ আহমাদের দাদা সোলায়মান বেগকে দাওয়াত পাঠান। তিনি সপরিবারে সেই দাওয়াতে হাজির হন। ইয়েমেনের জ্বীন প্রধাণ খুব আপ্যায়ন করলেন মেহমানদের। দাওয়াত গ্রহন শেষে ফিরে আসার সময় অনেক উপহার দেন।
কিন্তু সেই উপহার গুলির মাঝে "খাস" একটা উপহার থাকে। সেটা হচ্ছে একটা ফুটফুটে জ্বীনের কন্যা শিশু!!
সোলায়মান বেগের খুব মায়া লাগে বাচ্চাটাকে দেখে। কারণ তার কোন মেয়ে নেই।তার স্ত্রীও খুব আনন্দিত হয় জ্বীন কন্যা শিশু টিকে পেয়ে। ইয়েমেনে জ্বীন প্রধান জানায় বাচ্চাটা এতিম। তারা চাইলে তাকে নিজেদের সন্তানের মতো লালন পালন করতে পারে।
সোলায়মান বেগ তাদের সাথে বাচ্চা টিকে নিয়ে আসেন। তিনি আর তার স্ত্রী মিলে কন্যা শিশুটার নাম রাখেন" সাবরিন" অাহমাদের বাবা সালমান বেগ খুব খুশি হয় নতুন বোনকে পেয়ে।
সোলায়মান বেগের পরিবার নতুন সদস্য পেয়ে খুশি হলেও, খুশি হয়না তাদের জ্বীন সমাজ।
তারা অন্য দেশ থেকে আসা এতিম শিশুটাকে সমাজে মেনে নিতে চায়না। তারা তখন সোলায়মান বেগের বিরোধীতা করে। তাদের কে অনেক বুঝানোর পর তারা শান্ত হয়। কিন্তু শর্ত দেয়, এই মেয়েকে সোলায়মান বেগের বংশ পরিচয়ে পরিচিত করানো যাবেনা এবং সে যদি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে জ্বীন সমাজের কোনো নিয়ম ভংগ করে তাহলে তাকে তো শাস্তি পেতেই হবে সাথে সোলায়মান বেগও তার জ্বীন সমাজের প্রধাণ থাকার ক্ষমতা হারাবেন।
অাহমাদের দাদা সোলায়মান বেগ তাদের শর্ত গুলি মেনে নেন। সাবরিন কে আদর স্নেহ দিয়ে বড় করে তোলেন।
সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিলো তাদের পরিবারে। আহমাদের আর আসাফসানার জন্ম হয়। তাদের কাছে তাদের সাবরিন ফুফুজান খুব প্রিয় ছিলো।সাবরিনের সারা সময় কাটতো ভাতিজা, ভাতিজি কে নিয়ে।
হঠাৎ একদিন আহমাদ বুজতে পারে তাদের ফুফু আর আগের মতো নেই। তাদেরকে বেশি সময় দেননা। প্রাসাদের বাহিরেই বেশি সময় কাটান।
একদিন সাবরিন আর ঘরেই ফিরেনা।সোলায়মান বেগ অনেক খোজেন মেয়েকে। কিন্তু সাবরিন কে পাওয়া যায়না।
এর প্রায় বছর খানেক পরে আহমাদ দের কাছে খবর আসে তার ফুফু এক মানুষ জাতিকে বিয়ে করে তাদের সমাজে থাকছেন!
খবর খুব দ্রুত পুরো জ্বীন সমাজে ছড়িয়ে যায়। প্রভাবশালী জ্বীনরা তখন সাথে সাথে সোলায়মান বেগের ক্ষমতা ছিনিয়ে নেন এবং তাদের খুব অপমান করেন। তারা সাবরিন আর তার মানব স্বামী শোয়েব কে খুজে বের করে আটক করেন। তখন সাবরিনের কোলে তার চল্লিশ দিনের কন্যা শিশু!
মানব জাতিকে বিয়ে করার অপরাধে সাবরিন আর তার স্বামী কে সারা জীবনের জন্য কারাদন্ড দেয় জ্বীন সমাজ।
কিন্তু তাদের নব জাতক শিশু কন্যাটিকে তারা মেরে ফেলতে চায়। সোলায়মান বেগ তখন তাদের কাছে অনেক মিনতি করেন তারা যেনো বাচ্চা টাকে না মেরে ফেলে।
কিন্তু তারা কিছুতেই রাজি হয়না। অনেক অনুরোধের পর তাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ জ্বীন এগিয়ে আসে। তিনি সবাইকে বুঝিয়ে বলেন এই কন্যা সন্তান তার আঠারো বছর বয়সে পা দিলেই সে জ্বীন জাতির মত সব ক্ষমতা,অাচার,স্বভাব এর অধিকারী হবে। তাই তাদের নিজেদেরই একজন কে হত্যা করে ফেলা কোনভাবেই উচিৎ হবেনা তাদের। কিন্তু এই মেয়ে তখনি তাদের সমাজে ফিরে আসতে পারবে যখন তাকে জ্বীন জাতির মধ্যে কোনো ক্ষমতাবান, শক্তিশালী পুরুষ বিবাহ করবে। তার আগ পর্যন্ত তাকে মানব সমাজেই থাকতে হবে।
বৃদ্ধ জ্বীনের কথার সাথে অন্য সব জ্বীনরা সায় দিলো।সোলায়মান বেগ জ্বীন সমাজের এই রায় শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন। মনে মনে অাল্লাহকে শুকরিয়া জানান।
কিন্তু সাথে সাথেই তিনি ভাবেন, মানব সমাজের কার কাছে তিনি তার নাতনি কে দিবেন? কে তার দায়িত্ব নিবে আঠারোটা বছর পর্যন্ত? তিনি ভাবনায় পরে যান।
কিন্তু পরক্ষনেই মনে পরে তার মানব মিত্রের কথা। যার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ এর পরেই খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিলো সোলায়মান বেগের। তার চোখে ভেসে উঠলো বন্ধু আজহার ইসলামের ছবি। সোলায়মান বেগের সব চিন্তা নিমিষেই দূর হয়ে গেলো!!



চলবে.......... 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা