গল্পঃ "জ্বীন প্রতিবেশী" --- পর্বঃ ০৫

গল্পঃ "জ্বীন প্রতিবেশী"

পর্বঃ ০৫  


আজহার ইসলাম মনে মনে দোয়া দুরুদ পরা শুরু করলেন। ভালোয় ভালোয় এখন ফিরে যেতে পারলেই বাঁচেন তিনি। চোখ বন্ধ করে স্ত্রী অার আট বছরের মেয়ে লাবনি ইসলামের কথা ভাবতে থাকেন।
হঠাৎ একটা শব্দ তার কানে আসে তিনি চোখ খুলে দেখেন পালংকের পাশে দুটো মাঝারি আকারের সাপ ফণা তুলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আজহার ইসলাম 'ইয়া আল্লাহ" বলে জোরে এক চিৎকার দেন। তার চিৎকার শুনে সোলায়মান বেগ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘরে ঢুকেন।
--"
কি হয়েছে ইমাম সাহেব?
জিজ্ঞেস করতে করতেই সাপ দুটো তার চোখে পরে। তিনি সাপ দুটোকে অন্য ভাষায় ধমক দিয়ে কি যেন বললেন। ভাষাটা অনেকটা আরবী ভাষার মতো মনে হলো আজহার ইসলামের কাছে। সাপ দুটি সাথে সাথে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে।
--"
আপনি ভয় পাবেন না। এরা আমার ছেলে মেয়ে।আপনাকে দেখতে এসেছে। কোন ক্ষতি করবে না ওরা।"
--"
ওহ আচ্ছা!"
অাজহার ইসলামের খুব পানির পিপাসা লাগে। তিনি বলতে যান পানির কথা, তখনি সোলায়মান বেগের হাতে একটা পিতলের পাত্রে পানি দেখতে পান। তিনি তার দিকে পাত্রটি এগিয়ে দেন। আজহার ইসলাম কাঁপা কাঁপা হাতে পাত্রটি ধরে এক ঢোক পানি গিলেন। পানিটার স্বাদ তার কাছে অন্যরকম মনে হয়। তিনি তৃপ্তি সহকারে পুরোটা পান করে ফেলেন।
--"
ইমাম সাহেব,আপনি ক্ষুধার্ত। দয়া করে এই ফল আর খাবার গুলি খেয়ে নিন।"
সোলায়মান বেগের হাতে পিতলের পাত্র ভর্তি হরেক রকমের ফল আর মিষ্টান্ন। আজহার সাহেব ভাবলেন একটু আগে তো লোকটার হাতে এসব ছিলো না। এখন আসলো কোথাথেকে! তখন তার মনে পরলো, তার দাদী বলেছিলেন জ্বীন জাতি চোখের পলকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বিচরণ করতে পারে। আল কুরআন এবং হাদিস শরিফেও লিখা আছে কথা।
আজহার ইসলাম খাবার গুলি খেতে সংকোচ বোধ করেন। কিন্তু তিনি কখনোই ক্ষুধা নিয়ে থাকতে পারেন না। তিনি আপেলের মত দেখতে একটা ফল হাতে নেন।কিছুক্ষণ ফল টা কে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আস্তে একটা কামড় বসালেন। খুবই মিস্টি একটা ফল। দেখতে আপেলের মত হলেও এর স্বাদ মিষ্টি অামের মতো। আজহার ইসলাম দুটো ফল খুব আগ্রহ করে খেলেন।
--"
আপনাকে পৌছে দেয়ার সময় হয়ে গেছে ইমাম সাহেব। দয়া করে অাপনি চোখ বন্ধ করে নিন।"
সোলায়মান বেগের কথা শুনে আজহার ইসলাম চোখ বন্ধ করলেন। তার মনে হচ্ছে রাজ্যের ঘুম তার দুচোখের পাতায় নেমে এসেছে। তিনি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।
চারদিকে ফজরের আজান হচ্ছে। আজহার ইসলামের ঘুম ভেংগে গেলো। তিনি হকচকিয়ে উঠে বসলেন।মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেব ছুটিতে বাড়ি গেছেন। কদিন আজান দেয়ার দায়িত্ব আজহার ইসলামকে দিয়ে গেছেন।
আজহার ইসলাম মনে করার চেষ্টা করলেন, কিছুক্ষণ অাগে যেখানে গেলেন, যাদের দেখলেন এসব কি স্বপ্ন ছিলো নাকি বাস্তব! তার সব কিছু খুব স্পষ্ট ভাবে মনে হতে লাগলো।
তিনি আজান দেয়ার জন্য বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। অজু খানার দিকে যাওয়ার সময় হটাৎ তিনি খেয়াল করলেন তার বালিশের পাশে ফলের মত কিছু রাখা। যেটা দেখতে অনেকটা আপেলের মতো! আজহার ইসলাম আর কিছু চিন্তা না করে আজান দিতে চলে গেলেন। পাছে আবার নামাজের ওয়াক্ত চলে যায়!!
নামাজ আদায় করে আজহার ইসলাম সেই ফলটা নিয়ে বাড়ি গেলেন। তার বাড়ি মসজিদ থেকে কয়েক গজ দূরে। তিনি ঘরে প্রবেশ করে দেখলেন তার স্ত্রী নামাজ পরে তাসবিহ পরছেন। তিনি ঘরে ঢুকে খুব সাবধানে দরজা লাগিয়ে দিলেন। তাদের বিছানাতেই তাদের একমাত্র মেয়ে লাবনি ইসলাম ঘুমাচ্ছে। তিনি মসজিদে থাকলে তার স্ত্রী মেয়েকে নিজেদের বিছানাতে নিয়েই ঘুমান।
ঘরে প্রবেশ করতে তার স্ত্রী তাকে সালাম দিলেন। তিনি সালামের উত্তর নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
--"
লাবনির মা, তোমাকে একটা কথা বলবো। কথাটা খুব গোপনীয়।"
তিনি কথাটা বলে ঘুমিয়ে থাকা মেয়ের দিকে তাকালেন।
--"
আপনি বলতে পারেন যা বলতে চান। মেয়ে ঘুমাচ্ছে।কিছু শুনতে পাবেনা। আপনি নিশ্চিন্তে বলুন।"
লাবনি ইসলামের মা তার স্বামী কে বললেন।
--"
লাবনির মা, আমি যা বলতে যাচ্ছি এই কথা কোনদিন কাউকে বলবেনা, যতদিন বেঁচে থাকবে। আজকে আমি জ্বীন জাতির সাক্ষাত পেয়েছি "
কথাটা বলে দম নিলেন তিনি। স্বামীর মুখে একথা শুনে লাবনি ইসলামের মায়ের মুখ হা হয়ে গেলো। তিনি মুখ ঢেকে রাখলেন হাত দিয়ে। বড় বড় চোখ করে স্বামীকে বললেন
--"
তারপর, তারপর কি হলো?"

আজহার ইসলাম পুরো ঘটনা খুলে বললেন। পকেট থেকে ফলটা বের করে স্ত্রী কে দেখালেন। লাবনির মা অনেক ভয়ে ভয়ে হাতে নিলেন সেটা।
--"
খুব মিষ্টি ফল। একটু খেয়ে দেখ।"
--"
না না লাবনির অাব্বু। অামি খেতে পারবো না এই ফল।"
তিনি আবার ফল টা স্বামীর হাতে দিয়ে দিলেন।
-- "
একটু খেয়ে দেখোনা। খুব স্বাদ। অল্প একটু খাও"
স্বামীর অনুরোধে একটা কামড় দিলেন। সত্যি, অতুলনীয় স্বাদ এই ফলটার। লাবনির মা আরেক কামড় বসান।
দুজন ফল টা খেয়ে, কথা বার্তা শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
বাবা, মা ঘর থেকে বের হওয়ার পর চোখ খুলে লাবনি ইসলাম। আজকে তার ঘুম খুব ভোরেই ভেংগে গেছে।বাবা মা ঘরে থাকায় এতোক্ষণ ঘুমের ভান করে শুয়েছিলো সে। বাবা তার মাকে যা বলেছে সব স্পষ্ট শুনেছে সে।
##
--"
মা, উঠো। অনেক বেলা হয়ে গেছে। তোমার জন্য নাস্তা রেডি করেছি। এক সাথে খাবো।"
অনিলা মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলে। ছুটির দিনে সে নিজ হাতে মায়ের জন্য নাস্তা তৈরী করে। মা কে বিশ্রামের সুযোগ করে দেয়।
লাবনি ইসলাম চোখ মেলে ঘড়ি দেখেন। সাড়ে 'টা বেজে গেছে। বাজার করতে যেতে হবে তাকে। তিনি উঠে ফ্রেস হয়ে নেন।
--"
ঘুম কেমন হলো মা?"
অনিলা মায়ের কাপে চা ঢেলে দেয়।
--"
ভালোই হয়েছে মা। তুই কি খুব জলদি উঠেছিস নাকি আজকে? এতো কিছু বানিয়ে ফেললি!"
লাবনি ইসলাম হাসি দিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন।গতকাল রাতের অভিমানের ছিটেফোঁটাও নেই মেয়ের মুখে। মেয়েটা এমনি। তার সাথে অভিমান করে থাকতেই পারেনা।
--"
হুম মা। খুব তাড়াতাড়ি উঠে গেছি।"
রোদ পড়ছিলো রুমে অনেক। কেন জানিনা, রোদ ভালো লাগছেনা অাজ।
অনিলার একথা শুনে লাবনি ইসলাম চায়ে চুমুক দেয়া থামিয়ে দিলেন!
আর ঠিক দের মাস পর আরবী " সফর" মাসের সাত তারিখ অনিলার আঠারো বছর পূর্ন হবে। সেদিন থেকে অনিলার মাঝে মানুষদের যতো গুনাগুণ, আচরণ, স্বভাব আছে সেগুলি ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।
লাবনি ইসলামের মনে হচ্ছে আজকে থেকেই হয়তো সেটা কিছুটা শুরু হয়েগেছে। কারণ সকালের রোদ গায়ে মাখানো অনিলার প্রিয় কাজের মধ্যে একটি।
লাবনি ইসলাম ভাবনায় পড়ে যান। কিভাবে যে সব কিছু জানাবেন অনিলাকে তিনি!
--"
কি ভাবছো মা? খাচ্ছনা যে!"
অনিলা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মা কি যেন ভাবছে অনেক্ষন থেকে!
--"
মা,আমার হাতের তাবিজ টা টাইট হয়ে আসছে।বদলে দিওতো। ব্যাথা পাই হাত নাড়ালে।"
লাবনি ইসলাম একথা শুনে চোখ নিচের দিকে নামিয়ে বললেন,
"
আর বদলাতে হবেনা ওটা। দেড়টা মাস কষ্ট করে পরে থাক মা। তারপর আর কখনো তোকে তাবিজ পরতে হবেনা মা।"
--"
তাই! খুব ভালো হবে তাহলে মা।"
অনিলা খুব উচ্ছাস নিয়ে বলে।
--"
আমার বুঝ হওয়ার পর থেকেইতো হাতে তাবিজ বাধা দেখছি। একদম ভালো লাগেনা পরতে।"
অনিলা তাবিজটাকে হাত দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলে।
লাবনি ইসলাম আর কিছু বলেননা মুখে। মনে মনে ভাবেন, " তোকে প্রথম যখন আমার কোলে "তারা" তুলে দেয়, তখন থেকেই এই তাবিজ তোর হাতে বাধা দেখেছি। "তারা" বলেছিলো, যেদিন তোর আঠারো বছর পূর্ণ হবে সেদিন থেকে এই তাবিজ আর পড়া লাগবেনা। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত বারো মাসে বারো টা তাবিজ তোকে বদলিয়ে বদলিয়ে পড়াতে হবে। "তারা" দুইশো চৌদ্দটা তাবিজ আমার হাতে দেয়। প্রতি মাসের প্রথম চাঁদরাতে তোকে তাবিজ গুলি হাতে লাগিয়ে দিয়েছি আমি।"
লাবনি ইসলাম নাস্তা শেষ করে উঠে যান। এখন আর বাজারে যেতে মন চাচ্ছেনা তার। অফিসের পিয়ন কে কল দিয়ে করে বাজার করে দিয়ে যেতে বলবেন।
তিনি আজকে সারাদিন অনিলার সাথে কাটাতে চান।
অনিলার রুমে যেয়ে দেখেন অনিলা চুল আচড়াচ্ছে।
--"
আয় মা, তোর চুলে তেল লাগিয়ে দেই। লাবনি ইসলাম তেলের বোতল হাতে নিয়ে অনিলার পাশে দাঁড়ালেন।
-- "
বাহ মা। আজকে দেখি তুমি অনেক ভালো হয়ে গেছো। তুমিতো হাতে তেল লাগাতেই চাওনা।"
মেয়ের কথা শুনে লাবনি ইসলাম হেসে উঠেন। মেয়েকে কাছে টেনে চুলে তেল দেয়া শুরু করেন।
সকাল থেকেই অনিলার ইচ্ছা করছিলো একটু আফসানাদের ফ্লাটে যেতে। আফসানার ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে তার। "আহমাদ" অস্ফুট ভাবে উচ্চারন করে সে।
অনিলা ভেবেছিলো মা বাজারে গেলে এক ফাঁকে আফসানাদের বাসায় যাবে। কিন্তু মায়ের মতি গতি দেখে মনে হচ্ছেনা যে মা বের হবে বাজার করতে।
--”
মা,বাজার করতে যাবে না। প্রতি শুক্রবার সকালেতো বাজার করো তুমি।"
অনিলা ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।
লাবনি ইসলাম মেয়ের মাথা আবার সামনের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে চুল আচড়াতে আচড়াতে বলেন,
-- "
আজকে আমি কোথাও যাবনা। অাজ সারাদিন তোর সাথে গল্প করবো।"
--"
থ্যাংকস মা। অনিলা হাসি দিয়ে মাকে ধন্যবাদ জানায়।
লাবনি ইসলাম সারাদিন অনিলার সাথে কাটাবেন শুনে অনিলা খুব খুশি হয়। মাকে তো তেমন পাওয়াই হয়না তার। কিন্তু মা বাসায় থাকলে আহমাদ কে কোনভাবেই দেখা যাবেনা ভেবে মন খারাপ হয়।
কিন্তু আহমাদের জন্য এতো মন টানছে কেনো তার? সে নিজেকেই প্রশ্ন করে। অনিলা বুঝতে পারে, এই প্রথম তার মনে কোন পুরুষের ভাবনা আসছে! এমনটা আগে কখনো কল্পনাও করেনি সে।



চলবে.......... 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা