গল্পঃ কোনো এক ঝড়ো সন্ধ্যায়

গল্পঃ কোনো এক ঝড়ো সন্ধ্যায় 
লেখকঃ তাহসিন মাহমুদ তামান্না  

বাবা আর ছেলে মিলে অপলক দৃষ্টিতে অনেক আগ্রহ নিয়ে এক কাপ চায়ের দিকে তাকিয়ে আছে । ছোট বলে টেবিলটা সোহানের ঠিক নাগাড়ে আসে না । অনেকটা উবু হয়েই বাবার সাথে চা পর্যবেক্ষণ করছিল সে । এদের কেউই চা খেতে আগ্রহী নয় । এদের আগ্রহ চায়ের কাপের ধোয়াগুলোর উপর । একটা ঘন মেঘের মত সৃষ্টি করে কুন্ডলী পাকিয়ে সবগুলো উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে আর চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে । যেন প্রকৃ্তি চায়ের পানিগুলোর কাছে এসে ফিসফিস করে বলে গেছে ,” চলে এসো, আমার হাওয়ায় মিশে যেতে – চলে এসো ।“ ঘোরের মধ্যে পানিগুলোও তাই ধীরে, খুবই ধীরে মিলে যাচ্ছে বাতাসের সাথে । দুধটায় পানি কমে যাচ্ছে । উপরে চিকচিক করে ধীরে ধীরে একটা সর ভেসে উঠছে । আর সেই সরের সাথে লাইটের আলো মেতে উঠেছে লুকুচুরি খেলায় ।
ধোয়ার ব্যাপারটা কিন্তু খুবই ইন্টারেস্টিং । সব ধরণের ধোয়ার মধ্যেই আলাদা আর্ট আছে । এই ধোয়া হলো জমিনের মেঘ । জমিনে যার নাম ধোয়া , আকাশে মেঘ । প্রকৃ্তিতে মিলে যাওয়ার সময় ধোয়াগুলো কতনা চেনা-অচেনা আকার ধারণ করে । নিকোটিনাভো ধোয়াগুলোরও আছে আলাদা সৌন্দর্য । এদের হাবভাব দেখে মনে হয় এরা সবগুলো কণা একটা প্রতিযোগিতায় নেমেছে । কে কত দ্রুত সিগারেটের সরু কাঠিটা থেকে বের হয়ে কত দূরে সরে যেতে পারে । যদিও ব্যাক্তি বিশেষে এর গন্ধের পছন্দ – অপছন্দতার ভেদাভেদ আছে । সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হচ্ছে পানির ভেতরে যে ধোয়াগুলো সৃষ্টি হয় । গরম পানিতে এক চামুচ কফি পাউডার ঢেলে দিলে সেটার হাল্কা খয়েরী ধোয়া যখন পাক খেয়ে কাপের পানির উপর পর্যন্ত এসে পুরো পানিতে মিলিয়ে যায় , সেটা মনের মাধুরী নিয়ে দেখা শুরু করলে হয়তো অনন্তকাল ধরে চেয়ে থাক্লেও দেখা শেষ হয়ে ক্লান্ত হওয়া হবে না ।
চা ঠান্ডা হয়ে গেছে ।সার্থক এই চায়ের কাপ দিয়ে তার ছেলেকে পানির ভৌত অবস্থার পরিবর্তনটা বোঝাতে তার থেলেকে নিয়ে পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছিল । তাদের পর্যবেক্ষণের ঠেলায় চায়ের উত্তরসূত্রী হিসেবে ঠান্ডা চা এখন রোকসানার পরিবর্তে সোহান বা সার্থককেই খেতে হবে । দু’জনের কেউই চা খেতে আগ্রহী নয় । এ পরিবারে চা খাওয়ার অভ্যাসটা কেবল রোকসানার । দৈনিক ৪-৫ কাপ লিকার চায়ের সাথে সন্ধ্যায় ঘন করে জাল দেয়া এক কাপ দুধ চা না খেলেই নয় । এই গরমকালেও চা তার চাই । চা টা অবশ্য বিকেলে তৈ্রী । কি একটা ফোন পেয়ে রিসিভারটা নামিয়ে সার্থকের হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল ।
-কোথায় যাচ্ছ তুমি ? -বড় ফুপুর শরীরটা বেশি ভালো না । আমাকে নাকি দেখতে চেয়েছেন ।
সটাৎ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল । রোকসানার থেকে থেমে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার শব্দটা ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে লাগল । দমকা হাওয়া বইছে । সন্ধ্যার দিকে ঝড় হতে পারে । কিন্তু সার্থকের পক্ষে রোকসানাকে আটকানো কোনভাবেই সম্ভব না । ব্যার্থ প্রচেষ্টা না করে সার্থক তাই ব্যালকনি দিয়ে দিয়ে শুধুই রোকসানার চলে যাওয়া দেখল ।
রোকসানার সাথে সার্থকের বিয়ে হয়েছিল বছর দশেক আগে এক চৈত্র মাসে । সেদিন রাত্রেও ভয়ানক ঘূ্র্ণিঝড় হয়েছিল । এক মুহূর্তের জন্য স্বার্থকের মনে হয়েছিল , প্রকৃ্তি হয়তো তাদের সম্পর্কটা মেনে নেয় নি । রোকসানা ভয়ে সেদিন শক্ত করে স্বার্থকের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল । গত ১০ বছরে মেয়েটা তার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে এভাবেই তার পাশে ছিল । কোনদিন স্বার্থকের নিজেকে একা মনে হয় নি ।

কোনো এক ঝড়ো সন্ধ্যায়

-বাবা , চা ঠান্ডা হয়ে গেছে ।খাবে কে ? -আমি খেয়ে নেব। তুমি বরং পড়তে বস।
স্বার্থক কোন কারণ ছাড়াই চায়ের কাপটাকে দেখছে । এখনো হালকা কুসুম গরম আছে।
একটা চুমুক।
কড়া মিষ্টি পানি পানি একটা স্বাদ। বিস্বাদ বলা ভালো । কিনতি স্বার্থক মুটামুটি আয়েশ করেই চা খেল । বারান্দায় এসে দাঁড়াল । ঝড়ো হাওয়ার মাতলামি শুরু হয়ে গেছে । দমকা হাওয়ায় বড় বড় গাছগুলো নিজেদের ভীড়ে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে । একটা বাদুড় ঝড়ের বিপরীতে যেতে ব্যাস্ত। কিন্তু ঝড়ো হাওয়া যেন জিদ ধরে বসেছে তাকে কিছুতেই যেতে দেবে না । একটা সিগারেট ধরানো যায় । ঝড় শুরু হতে বেশি দেরী নেই । সোহান হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে । আজকে বাসায় মা নেই , পড়াও নেই । স্বার্থকের এসব নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই । করুক না একটু ছেলেমানুষি । সিগারেটের লম্বা একটা টান আর দমকা হাওয়া ছুটে এসে গায়ে লাগা । বারান্দার গ্রিলের উপর রাখা হাতটায় একফোটা পানি এসে পড়ল । নাহ , পানি না । বৃষ্টির ফোঁটা । প্রথম ফোঁটা ? মানুষজন বলে বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা নাকি আশীর্বাদ প্রথম ফোঁটায় নাকি রহমত থাকে । কারো গায়ে সেই রহমতের ফোঁটা পড়লে নাকি তার মনোবাসনা পুর্ণ হয় । কিন্তু এই কথাটা নিতান্তই যুক্তিহীন বলে মনে হয় । খোদার যদি রহমত দিতেই হয় , তাহলে বৃষ্টির ফোটাতেই কেন ? তাও আবার শুধু প্রমটাতে ? প্রথম ফোঁটাটাকি কাউকে উদ্দেশ্য করে পাঠানো? নাকি রহমত ছেড়ে দেয়া আছে – ফোঁটা যার , রহমত তার । আচ্ছা , প্রথম ফোঁটাটা যদি মাটিতে পড়ে যায় , তাহলে কি মাটির মনোবাসনা পূর্ণ হবে ? মাটির কি মন আছে ? মাটির মনোবাসনা কি হতে পারে ? ঝড়ো হাওয়ার উন্মাদনায় তাল মিলাতে শুরু হয়ে গেল পুরো দমে বৃষ্টি। রাস্তার ছেলেগুলো হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দিয়েছে । আম গাছের নিচে জড়ো হয়েছে সব । এদের বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগার ভয় নেই । ভয় নেই মায়ের বকুনির । ঝড়ে যে মাথায় বাজ পড়তে পারে সেই চিন্তাও নেই। এই শহুরে পরিবেশের মাঝে আধো অপূর্ণ গ্রামীণ ছেলেবেলা – মন্দ নয় ।
-বাবা, মা আসবে না ? -তুমি ঘুমাও নি ? -মা আসবে কখন ? - আসবে , একটু পরে । - আসলে আমাকে ডেকে দিও ? - আচ্ছা, তুমি ঘুমাও।
ছেলেটা শুয়ে পড়ল । মা কে না পেয়ে যেন তার বড্ড একা লাগছে । মায়ের ভালোবাসার স্বাদটা কেন যেন বাবার মাঝে পাওয়া যায় না । মা মানেই বিশেষ কেউ।
বৃষ্টির ছিটে ফোটা গায়ে এসে লাগছে । সেই সাথে দমকা হাওয়া । এক ঝলক পানি এসে স্বার্থকের চশমার গ্লাসটা ভিজিয়ে দিয়ে গেল। চশমার গ্লাসগুলো টি শার্টের কাপড়ে মুছতে মুছতে স্বার্থক আকাশের দিকে তাকালো । চশমা ছাড়া দেখা অস্পষ্ট আকাশে কিছু ধূসর মেঘ গর্জন করছে । সেই ধুসর মেঘের সুরে তাল মেলালো আগ্নেয়াভো কিছু বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ আর রেখা। গাছের ঝরে পড়া পাতাগুলোও খুবই ব্যাস্ত । আজীবন গাছের শাখায় বন্দী জীবনের যেন মুক্তি মিলেছে । স্বাধীনতার মড়মড় হাক ছেড়ে তারাও উড়াল দিয়েছে যেন অচিন পথে অনিকেত হতে । কারণ আজতো তাদের কোন বাধা নেই । পথ রুখে দেয়ার মতোও কেউ সামনে দাঁড়িয়ে নেই । আজ দূরত্বে্র কোন সীমা নেই । তাই হারিয়ে যেতেও কোন মানা নেই ।

The End  

Credit By :  Tahsin Mahmud Tamanna

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা