গল্পঃ যাত্রা

গল্পঃ ভ্রমন যাত্রা 
লেখকঃ অভ্র আরিফ 

আমার বিশ্রী একটা সমস্যা আছে। বাসে-ট্রেনে উঠলেই আমার ঘুম পায়। এমনিতে রাতে তেমন ঘুম হয় না। দিনের বেলা বাসে উঠলে রাজ্যের ঘুম চলে আসে। কোত্থেকে আসে কে জানে। আমার ধারণা আমি যদি ঢাকায় রাস্তায় রোলার স্কেটিংও করি ঘুমিয়ে যাবো। ঘুমানোর এই বদ অভ্যাসের কারণে পাশের সিটে সুন্দরী কোনো মেয়ে থাকলেও সচরাচর তাই আমি বসতে চাইনা। কিংবা আমার পাশে খালি সিটে সুন্দরী কোনো মেয়ে এসে বসলেও, উঠে অন্য সিটে চলে যাই অথবা উঠে দাঁড়িয়ে থাকি। এতে সুন্দরীরা নিশ্চয়ই অপমানিত বোধ করে কিংবা কে জানে হয়তো স্বস্তিও পায়। আমি মূলতঃ উঠে দাঁড়াই চরম কোনো অস্বস্তিকর মূহুর্ত থেকে নিজেকে রক্ষা করবার জন্য। আমার কিঞ্চিৎ নাক ডাকার অভ্যেস আছে। আর বাসের সিটে মাথা হেলান দিয়ে ঘুমালে মুখটা এমন বিশ্রী হা হয়ে যায় যে, এ মুখ দিয়ে ছোটখাটো একটা খেলনা ট্রেন আসা-যাওয়া করতে পারবে। এমন বিশ্রী দৃশ্যের কিছু ফটো আমার বন্ধু-বান্ধবদের কাছে আছে। আমরা হয়তো বাসে করে কোথাও যাচ্ছি কিংবা দল বেঁধে হুল্লোড় করতে করতে পিকনিকে যাচ্ছি, আমি এসবকে পাত্তা না দিয়ে হা করে ঘুমিয় গেলাম। আর মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করা হলো সেই দুর্লভ মূহুর্তগুলোর স্থিরচিত্র যেগুলো এখন আমার দুর্বল জায়গা। কারণ প্রতি মুহূর্তেই ঐসব ছবিগুলো ফেসবুকে ছেড়ে দেয়ার হুমকি পাই। ভয়ে থাকি। কোনোদিন হয়তো সকালে পেপার হাতে নিয়ে ফ্রন্ট পেজেই আমার সুবিশাল হা করা ছবি ছাপানো দেখবো। ক্যাপশনে লেখা, “ চৈত্রের খরদুপুরে ঢাকার দুর্বিষহ যানজটে আটকে হা করে ঘুমিয়ে গেলেন এক যাত্রী”। হয়তো “হা করে” কথাটা লেখা থাকবে না। কিন্তু সকল পাঠক চৈত্রের খরদুপুর, ঢাকার জ্যাম ছাপিয়ে আমার “হা করা” ছবিটা নিয়েই বেশি মেতে উঠবে।
- ‘আপনি বসুন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’ মেয়েটি অনুযোগের স্বরে বললো।
- আসলে আমি দাঁড়িয়েই কমফোর্ট ফিল করছি। তাছাড়া অনেকক্ষণ বসে থেকে থেকে হাত পা খিল ধরে গেছে।
- আপনিতো বসলেনই না মোটে। সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার পাশে বসতে কী আপনার অস্বস্তি হচ্ছে?
মনে মনে ভাবলাম, এই মেয়ে এতো কথা বলে কেন? আমার বিরক্তি হতে শুরু করলো। সুন্দরী মেয়েদের একটা না একটা প্রবলেম থাকবেই। হয় সে বোকা বোকা কথা বলবে, নাহয় অতি চালাকী দেখাতে গিয়ে বেশি বেশি কথা বলবে। এই মেয়ে বেশি কথা বলছে। আমি দাঁড়িয়ে যাই অথবা বাসের ভিতরে দৌড়াই তাতে ওর কী? আমিতো আর পাশের সিটে বসে ঘুমোতে ঘুমোতে তার ঘাড়ে মাথা এলিয়ে দিচ্ছি না।
- অস্বস্তি হবে কেন? আই অ্যাম ওকে। আসলে যুতসই কোনো জবাব না পেয়ে আমাকে বসতে হলো মেয়েটার পাশেই।
- কক্সবাজার যাচ্ছেন কেন? বেড়াতে?
- নাহ্! ট্রেনিং আছে। ওখানে বিয়াম ফাউন্ডেশনে সপ্তাহখানেকের জন্য একটা ট্রেনিংয়ে যাচ্ছি। আপনি? বেড়াতে যাচ্ছেন বুঝি?
- আরে না। একটা তরুণী মেয়ে একা একা কক্সবাজার বেড়াতে যায় বুঝি?
- তাহলে?

যাত্রা

- আমার বাসা কক্সবাজারেই। ওই বিয়াম ফাউন্ডেশনের উল্টোদিকে রাস্তার ওপাশেই আমাদের বাড়ি।
- অ। তাহলেতো ভালোই হলো। কক্সবাজারে আমার এই প্রথম আসা। বিয়াম ফাউন্ডেশনের এক্জাক্ট লোকেশনটাও আমার অজানা। আপনাকে পেয়ে ভালোই হলো। ঢাকায় কী করেন? পড়াশুনা?
- নাহ্! পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। চাকুরীর পরীক্ষা। আমি কক্সবাজার থেকেই পড়াশুনা করেছি।
- তাই? আমিও কালকে পরীক্ষা দিয়ে তারপার আজকে একা একা রওনা দিলাম। আমার কলিগরা আসলে গতকালকেই এখানে এসে পৌঁছেছে।
- ও। চাকুরী করেন তো?
- করি। আবার পরীক্ষাও দেই। বয়স আছে তাই দিচ্ছি আর কি!
- হুম। আপনাদের জন্য আমাদের চাকুরী হচ্ছে না। একটি চাকুরী করছেন। তবু এসব পরীক্ষায় এটেন্ট করে আমাদের কপাল পুড়ছেন। অথচ একটা চাকুরী আমার খুব দরকার।
আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। এই আশ্চর্য সুন্দর সমুদ্রকন্যা মেয়েটার শেষ লাইনটিতে একটি বিষাদ মাখানো ছুড়ির ফলা ছিল যেন। ছুড়িটা আমাকে বিদ্ধ করলো। আমি আহত হলাম।
চাকুরীটা তার খুব দরকার। কিন্তু কেন খুব দরকার সে কথাটা তাকে আমি জিজ্ঞেস করতে পারিনা। অযাচিত অভদ্রতা হয়ে যায়। হয়তো ঘরে অসুস্থ্য বৃদ্ধ বাবা মা। ছোট ভাইবোনগুলোর পড়াশুনার খরচ চালাতে পারছেন না। মাস শেষে সংসার আর চলে না প্রায়। কিংবা হয়তো বাব-মা বিয়ে দিয়ে দিতে চাচ্ছে তাকে। কিন্তু আশৈশব মন প্রাণ উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসার মানুষটা এখনো চাকরি পায়নি। মেয়েটার একটা চাকরি হলেই হয়তো দু’জনের সাদায় কালোয় জঞ্জালে ভরা লাল-নীল রঙ্গীন সংসারের স্বপ্ন। এসব ভাবতে ভাবতেই নিশ্চুপ ছিলাম কতক্ষণ খেয়াল নেই। সম্বিত ফিরে পেলাম ওর কথায়-
- আপনি ঘুমোতে পারেন। আমার কোনো প্রবলেম নেই। আমি লক্ষ্য করেছি। ঘুমের ঘোরে আমার কাঁধে একটু হেলান দিয়েছিলেন বলেই হয়তো আর বসতেছিলেন না সিটে। আই হ্যাভ নো প্রবলেম। যদি আপনার সমস্যা হয় খুব, আপনি ঘুমাতে পারেন।
আমি অস্বস্তির একটা হাসি দিলাম। সব সুন্দরী মেয়েই যে বোকা হয় আর বেশি কথা বলে তা নয়। কিছু কিছু মেয়ে আশ্চর্য নম্রতা, ভদ্রতা এবং বুদ্ধিমত্তায় এমন আবিষ্ট করে ফেলে যে বুকের ভিতর কোথায় যেন একটু যেন ব্যথা হয়। সুখের মতো ব্যথা। আমি হাসলাম। হাসিটা কী একটু বোকা বোকা হয়ে গেলো!
The End  

Credit By :  Avraw Arif


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা