গল্পঃ সুপার মুন ও বাইনোকুলার

গল্পঃ সুপার মুন ও বাইনোকুলার 
লেখকঃ অভ্র আরিফ 

“জোছনা দেখতে আসলা নাকি?” সুমন ভাই হাত নেড়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো। ছাদের ভূতুরে নির্জনতায় হঠাৎ সুমন ভাইয়ের ডাকে হতচকিত হয়ে যাই। রাত দু’টো। এতো রাতে ছাদে সুমন ভাই ও ভাবীকে দেখে বিস্মিত হলাম।
- ‘ঘুম আসতেছিলো না ভাই। তাই একটু আসলাম। এসে দেখি জোছনার প্লাবন।‘ কৈফিয়তের ঢঙে আমার বিনীত জবাব।
- ‘ও’তো আবার গল্প লিখে। তাই চাঁদের আলো হয়তো ওকে ঘুমোতে দিচ্ছে না’ টিপ্পনীর সুরে সুমন ভাইকে ভাবী বললেন।
আমি লজ্জা পেলাম। রুপা ভাবীর সাথে সরাসরি তেমন কথা হয় না আমার। রাস্তায় দেখা হলে সালাম দেয়া, একটু হাসি বিনিময়, এইতো। উনী চুপচাপ লাজুক টাইপের মেয়ে। আমিও ঠিক গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। তাই কথা আর বলা হয়ে উঠেনা তেমন। এই প্রথম তিনি ভাবীসুলভ একটা টিপ্পনী কাটলেন। আমি হাসলাম।
- গল্প আর লিখতে পারলাম কই ভাবী? কেউ আজ পর্যন্ত আমার গল্পকে গল্পই বললো না।
- আমার ভালো লাগে। ফেইসবুকে তোমার লেখা আমি সবসময় পড়ি। আমার সত্যি ভালো লাগে।
- ধন্যবাদ ভাবী।
- ‘আজকের রাত আর চাঁদকে নিয়ে একটা গল্প লিখে ফেলো আরিফ’ সুমন ভাই বলে।
আমি হাসলাম। সুমন ভাই চমৎকার একজন মানুষ। কী সুন্দর স্মার্ট, সুদর্শন, লম্বা একটা ছেলে! চোখে পাতলা ফ্রেমের একটা চশমা পড়েন। বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটা প্রাইভেট ফার্মে দু’বছর কাজ করেছেন। শুনেছি সামনের মাসে নিউইয়র্ক চলে যাবেন। রুপা ভাবী এখন যাবেন না। ওনার মাস্টার্স শেষে তারপর তিনিও চলে যাবেন। রুপা ভাবী ইংরেজি সাহিত্য মাস্টার্স করছেন। সুমন ভাইরা চলে গেলে আমার খারাপ লাগবে। সত্যিকার অর্থেই খারাপ লাগবে। আমাদের পাশাপাশি দুটো বিল্ডিং কিন্তু ব্যালকনি দুটো কাছাকাছি দূরত্বে। রোজই তাদের সাথে আমাদের দেখা হয়, কথা হয়। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মিষ্টি, পিঠা এসবের বিনিময়ও হয়।
সুমন ভাইদের ছাদে রেখে আমি ভিতরে চলে আসলাম। ঘুম আসতেছে না।
“কোনো কোনো রাত এমন হয় শত চেষ্টাতেও ঘুম আসে না। বিছানায় শুয়ে ছটফট করি। মাঝে মাঝে মন চায়, দারুণতম মিলনের অথবা বিরহের একটা রোমান্টিক প্রেমের গল্প লিখি। গল্পটি পড়ে পাঠক যেন উথাল-পাতাল প্রেমে পড়ার আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে অথবা বিরহের তীব্র সাধ পায়। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে আমার জীবনে কোনো প্রেম বা রোমান্টিকতা নেই। প্রেমের গল্প আমি কী করে লিখি! যে বৃক্ষে কোনোদিন ফুলই ধরলো না, সে ফুলের সৌরভ পাবো কোত্থেকে।
মাঝে মাঝে ভাবি, রুপা ভাবীর মতো একটা মেয়ে পেলে তাকে বিয়ে করে ফেলতাম। তারপর জ্যোৎস্নাপ্লাবিত কোনো রাতে সে যদি আবদার করতো, ‘চলো ছাদে যাই’ আমি মনে হয় একটা মহাকাব্য রচনা করতে পারতাম।“
এ পর্যন্ত লিখে কীবোর্ডের ব্যাকস্পেস বাটনটা চেপে ধরি। নাহ্! রুপাভাবীর কথা গল্পে টানা যাবে না। উনী আমার সব গল্প পড়েন। হয়তো গল্পগুলো সত্যি সত্যি পছন্দও করেন।
এরপর অনেকদিন রুপা ভাবীদের সাথে দেখা হয়নি। নানান ব্যস্ততা, সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা এবং সব শেষ দাদুর মৃত্যুতে অনেকদিন নিজের জগতের বাইরে চলে গিয়েছিলাম যেনো। প্রায় ছ’মাস পরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রুপা ভাবীর সাথে দেখা।
- কেমন আছো আরিফ?
- জ্বী ভাবী ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
- ভালো আছি। মাঝে কিছুদিন অসুস্থ্য ছিলাম। তোমাদের খোঁজ নিতে পারিনি।
আসন্ন সন্তান সম্ভাবনার কারণে স্ফীত উদরের জন্য ভাবী যেন একটু লজ্জিত।
- ঠিক আছে ভাবী। আপনার শরীর এখন ভালো? সুমন ভাই কেমন আছেন?
- আলহামদুলিল্লাহ এখন ভালো। তোমার ভাই তোমার জন্য একটা গিফ্ট পাঠিয়েছে নিউইয়র্ক থেকে। কিন্তু চারদিকে এমন অবস্থা যে তোমার বাসায় গিয়ে দিয়ে আসতে পারিনি।
- আমি পরে এসে একসময় নিয়ে যাবো।
- আজ বিকেলেই এসো।

সুপার মুন ও বাইনোকুলার

সুমন ভাই আমার জন্য একটা বাইনোকুলার পাঠিয়েছেন। ছাদে শুয়ে চাঁদ-তারা দেখা নাকি আমার অভ্যেস। তাই এই বাইনোকুলার। মানুষের একটু ভালোবাসায় আমার কেন গলা ভিজে উঠে আমি জানিনা। সুমন ভাই আমার কে? কেউনা। জাস্ট পাশের বাসার পরিচিত এক বড় ভাই। এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই সুদূল ইউএসএ থেকে বাইনোকুলার পাঠালেন। বেরুবার সময় ভাবী জোর করে সেমাই রান্না করে খাওয়ালেন। ভাবীর লাজুকতা একটু যেন কাটছে। এতো সহজ ব্যবহার আগে তিনি করেননি।
- তুমি এখন আর গল্প লিখো না কেন? তোমার গল্পের জন্য আমি অপেক্ষা করি।
- গল্প পাইনা ভাবী। কী নিয়ে গল্প লিখবো টপিকই পাইনা।
- আমি তোমাকে টপিক বলে দিবো। তোমার ভাই আর আমার ভার্সিটি জীবনের মজার মজার গল্প আছে। তুমি মাঝে মাঝে এসো আমি তোমাকে বলবো।
- আসবো। আপনাদের গল্প শুনতে আমার ভালো লাগবে।
- আর বড় বড় গল্প লিখবে যাতে পড়তে পড়তে আমার সারাদিন কেটে যায়। একা একা বাসায় ভালো লাগে না।
- লিখবো ভাবী। আজ তাহলে আসি।
- হ্যাঁ এসো।
বাইনোকুলারটা হাতে নিয়ে আমি চলে আসলাম।
............
বাইরের আকাশে উথাল পাতাল জোছনা। নেটে দেখলাম সুপারমুন না পিংকমুন যেন। ছাদে গেলেই হয়তো দেখতে পাবো। বাইনোকুলারটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করি। কেমন জিনিস এটা কে জানে? আমি কোনোদিন বাইনোকুলার দিয়ে চাঁদ বা তারা দেখিনি। আজ গিয়ে দেখলেই হয়। কিন্তু ইচ্ছে করে না। দেশব্যাপী চলমান লক ডাউনের কারণে সারাদিন বাসায় বসে বন্দী সময় কাটাই। গত সপ্তাহে সুমন ভাই নিউইয়র্কে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সেখানেই কোথাও হয়তো তার লাশটা সমাহিত করা হয়েছে অথবা কে জানে হয়তো পুড়িয়ে ফেলে দিয়েছে। রুপা ভাবীকে অনেকদিন দেখিনা। শুনেছি, বাপের বাড়ির লোকজন এসে তাঁকে নিয়ে গিয়েছে।
জানলার পর্দা উড়িয়ে দিয়ে চমৎকার বাতাস বইছে। আমার খুব করে এই জোছনা, এই সুপারমুন কিংবা এই বাইনোকুলার নিয়ে একটা প্রেমের গল্প লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পরক্ষণেই হাত গুটিয়ে নেই। বাঁচবো আর কয়দিন। গল্প লিখে কী হবে!!
(সমাপ্ত)

Credit By :   Avraw Arif

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা