গল্পঃ পাপেট শো


গল্পঃ পাপেট শো 
লেখকঃ হাসিন ইশরাক  
তুলা, কাঠের দেহ নিয়ে নেচে চলেছে প্রাণহীন সত্তা । কি অসাধারণ ! যেন সত্যি করেই জীবন পেয়ে গেছে । মাঝে মাঝে তো মনে হচ্ছে জীবন্ত মানুষের থেকেও অনেক ভাল করে নাচতে জানে । বড় বড় চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে । মুখে একটানা হাসি লেগেই আছে । এই হাসি যে কৃত্তিম তা যেন বিশ্বাস করা কঠিন । যতক্ষণ মঞ্চে নাচতে থাকে চোখ ধাধিয়ে যায় দেখে । এক সময় শো শেষ হলো । করতালিতে ভরে উঠলো সমস্ত হল । হলভর্তি দর্শকের মুখে হাসি । তাদের শিসে আর চিৎকারের ধ্বনিতে হল রমরম করছে ।

বাইরে সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা " জীবনকৃষ্ণের পাপেট শো " । নিচে মাঝারি সাইজে লেখা শরৎ চন্দ্র এভিনিউ , ৫ নং সড়ক , কোলকাতা । সময় বিকাল ৫ ঘটিকা ।

হলরুমের ভেতর এখন শুধু দুইজন । একজন জীবনকৃষ্ণ, আরেকজন তার হাতে থাকা সেই প্রাণহীন সত্তা । অবশ্য যতক্ষণ জীবনকৃষ্ণের হাতে থাকে সে, তাকে প্রাণহীন বলতেও কিছু দ্বিধা হয় । জীবনকৃষ্ণ তার পাপেট নিয়ে মঞ্চের পিছনের ঘরে চলে গেল । তার মুখে তৃপ্তির হাসি । আরেকটি শো বেশ দারুনভাবে শেষ হয়েছে । যতই দিন যাচ্ছে তার হাতের নিখুঁত কারসাজিতে দর্শক ততই বাজিমাত হচ্ছে । কামাইও বেশ ভাল । সারা জীবন ধরে এই সময়টার জন্যই সে অপেক্ষা করে আসছে । এখন তার বেশ নামডাক । দিন দিন তার কাজ আরও ভাল হচ্ছে । নিজেই নিজের কাজে মুগ্ধ সে ।

ঘরের ভেতর আলোর হালকা এক আভা বাইরে থেকে এসে পড়ছে । জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে ঘরে আলো ছায়ার অদ্ভুত এক ছবি তৈরি করে রেখেছে । বেশ কিছুদিন ধরে ঘরের বাতি নষ্ট । হাতে এখন টাকা পয়সা আছে । তাই এসব নিয়ে জীবনবাবুর এত মাথা ব্যথা নেই ।

সে পাপেটটা কে এক চেয়ারের উপর রেখে জামা পাল্টাতে লাগলো । হুট করে চেয়ার থেকে পাপেট টা পড়ে যায় আর তা দেখে জীবনবাবু হো হো করে হেসে উঠে । দেখলি পুতলা ? আমি ছাড়া তোর বইয়া থাকারও গতি নাই । তার পুতলা আগের মতই চেয়ে চেয়ে দেখে আর মুখে হাসি নিয়ে শুনতে থাকে । সত্যি-ই তো ! এই শরীরের সমস্ত প্রাণ সুতোর টানে টানে গাঁথা । তার এই তুলা আর কাঠের দেহ কে তো চালিয়ে নিয়ে যায় সামনে জামা পাল্টাতে থাকা এই সত্তা । সে কি করবে না করবে সবকিছু ঐ সত্তার আঙুলগুলি-ই ঠিক করে দেয় । নিজের শরীর তো নামমাত্র তার ।


*****

শরৎ চন্দ্র এভিনিউয়ের সড়কে ভিড় জমে গেছে । ভিড়ের মাঝে দিয়ে অল্প করে দেখা যায় পোস্টারে লেখা " যন্ত্রবাদক পাপেট " । নিচে বড় করে লেখা বিকাল ৫ ঘটিকা ।

দেখতে দেখতে শো এর দিন চলে আসে । এবারের শো তে বেশ কিছু নতুনত্ব । দর্শকদের মাঝে একঘেয়ে বিষয়টা আসতে দেয়া যাবে না । জীবনকৃষ্ণ তার পাপেট নিয়ে হলের পেছনের ঘরে চর্চা করে যাচ্ছে । খুব সূক্ষ্ম ভাবে মাথার উপরে থাকা এক তক্তার সাথে সুতোগুলি পেঁচিয়ে নিচে এনে নিজের আঙুলের সাথে বাঁধা হয়ে গেছে । অপর প্রান্তগুলি পাপেটের শরীরের ভিন্ন ভিন্ন অংশ ভেদ করে জায়গা করে নিয়েছে । আঙুলের প্রতি কম্পনে পাপেটের হাতে ধরে রাখা গিটার টাকে পাপেট নিজের হাত দিয়ে বাজাতে থাকবে । বেশ আয়ত্তে এসে গেছে ব্যপারটা !

বিকাল ৪ টা বেজে ৫০ মিনিট । ইতিমধ্যেই হলের ভেতর মানুষের কোলাহল পড়ে গেছে । সবাই মঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টে । আগে কখনো দেখেনি এমন এক উত্তেজনা নিয়ে সবাই চেয়ে আছে । সবার চোখে মুখে খেলা করছে কৌতূহল । এক পর্যায়ে মঞ্চে এলো জীবনকৃষ্ণ । সমস্ত হল করতালিতে ভরে উঠল । তারপর শুরু হলো শো ।

জীবনকৃষ্ণ পাপেটকে এক চেয়ারে বসিয়ে হাতে গিটার ধরিয়ে দিলো । ধীরে ধীরে তুলার হাত গুলিতে প্রাণ আসতে লাগলো । সে হাতগুলি নড়তে নড়তে একসময় গিটারের সূক্ষ্ম তারে সুর এর ঢেউ তুলতে লাগলো । সেই সুরের মাঝে হারিয়ে যেতে থাকল সামনে বসে থাকা দর্শক । তারা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল কিভাবে তুলা কাঠের এক দেহ সুর নিয়ে খেলা করতে জানে।

শো শেষ হলো । সব দর্শক যেন কল্পনার রাজ্য ছেড়ে বাস্তবে ফিরল । মুগ্ধতা কাটতে কিছু সময়, তারপরই তারা দাঁড়িয়ে করতালিতে আর শিষের শব্দে ভরে তুলল সমস্ত হল । তাদের চিৎকারে চিৎকারে জেগে উঠল শরৎ চন্দ্র এভিনিউয়ের ৫ নং সড়ক। কিছু মানুষ আবার ছুটে গেল মঞ্চের দিকে । জীবনকৃষ্ণ কে ঘিরে ধরল তার সাথে একটি ছবি তুলার জন্য । প্রচণ্ড ভিড় আর ঠেলাঠেলি লেগে গেল । এর মাঝে কে যেন চেয়ারে ধাক্কা দিয়ে পাপেট টিকে ফেলে দিল নিচে । জীবনকৃষ্ণ সেটি খেয়ালও করতে পারল না ভিড়ের কারণে । তার কি আর তখন এসব ভাবার সময় আছে ? সে এখন সাফল্যের চূড়ান্তে। তার ভেতরে খেলা করে চলেছে প্রাপ্তি।

তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসে । সমস্ত দর্শক হল থেকে বের হয়ে গেছে । এত সময় ধরে এত ছবি তুলে জীবনবাবু ক্লান্ত । হঠাৎ করে তার চোখ পড়ল মাটিতে পড়ে থাকা পাপেটের দিকে । তার সমস্ত তুলোর শরীর পায়ের নিচে চাপা পড়ে অজস্র কালচে দাগে ভরে গেছে । দাগ গুলি মুখে মেখেই বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে সে ।

পাপেট শো

*****

জীবনকৃষ্ণের চোখ জ্বলজ্বল করছে । এবারের পূজোয় তার শো পড়বে । সেখানে এই নতুন বুদ্ধি অনুযায়ী ঠিকঠাক সব করতে পারলে তার খ্যাতি কোলকাতা ছাড়িয়ে যাবে । ভাবতেই উত্তেজনায় তার লোম দাঁড়িয়ে যায় ।

৫ নং সড়কে এবার ভিড়ের মাঝে শোরগোল নেই । সবাই পোস্টারের লেখা পড়ে কিছু সময় চুপ মেরে যায় । কেউ বুঝে উঠতে পারছে না আসলে কি ঘটতে যাচ্ছে । হয়ত এটাই তাদের দেখা সবচেয়ে বড় চমক হতে যাচ্ছে ।

জীবনকৃষ্ণের গলায় ঠিক তার চামড়ার মত করে কিছু অংশ তৈরি করে লাগানো হয়েছে। সে অংশের নিচে পলিথিনের মত এক আবরণে রক্তের রঙের তরল। সে শো এর জন্য প্রস্তুত । এবার তার শো দেখতে আসবে কোলকাতার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি । তাদের সবাইকে চমকে দিয়ে একদিনেই খেলা নিজের হাতে ।

সময় বিকাল ৪ টা বেজে ৩০ মিনিট । হলের দরজা খুলে দেয়া হলো । এবার শো দেখার জন্য যেন পাগল হয়ে গেছে সমস্ত কোলকাতা । মানুষের ভিড়ের জন্য দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই । সামনের দিকের সিট আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রেখেছে কোলকাতার নামিদামি ব্যবসায়ীরা । ডাক্তার, শিক্ষক থেকে শুরু সব পেশার মানুষজন এসে বসেছে হলে । সবার চোখে মুখে উত্তেজনা ।

জীবনকৃষ্ণ মঞ্চে এসে উঠল । আজ সবাই করতালি না দিয়ে স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল তার হাতে রাখা পাপেটটার দিকে । পাপেটটি হাতে আজ ছুড়ি। জীবনকৃষ্ণ একটি চেয়ার টেনে এনে সেখানে কিছুটা হেলান দিয়ে বসলো । তারপর মঞ্চে পাপেটের নাচ আরম্ভ হলো । প্রতি কদম ফেলছে আর তার হাতে রাখা ছুড়িটা কাঁপছে । এক পর্যায়ে সে ছুড়ি বসিয়ে দেয় জীবনকৃষ্ণের গলায় । আর গলা দিয়ে বয়ে যেতে থাকে রক্ত ।

দর্শক যেন এই মুহূর্তের-ই অপেক্ষা করছিল । সবাই হাততালি দিয়ে উঠে । করতালি তে ভরে উঠে সমস্ত হলঘর । তাদের সামনে মানুষ খুন করে ফেলে প্রাণহীন সত্তা । করতালির শব্দ জোরে জোরে বাজতে থাকে সমস্ত ঘর জুড়ে। শুরুতে দর্শক ভয় পেলেও জীবনকৃষ্ণ ছিল নির্বিকার । সে জানে তার গলার চামড়ার মত অংশে ছুড়ি বসবে আর ভেতরে থাকা লাল তরল গড়িয়ে পড়বে বাইরে । ব্যাস এতেই সব কাজ শেষ । কি সহজ ! তারপর শুধু কিছু অভিনয় করে ব্যপারটা ফুটিয়ে তুলতে হবে ।

জীবনকৃষ্ণ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে । সে আর্তনাদ করতে থাকে । তবে এই আর্তনাদ এতটাই বাস্তব লাগছিল সবার কাছে যেন সত্যি সত্যি-ই সে মারা যাচ্ছে । জীবনকৃষ্ণ যতই মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে দর্শকের করতালির শব্দ আর চিৎকার আরও বেড়ে যাচ্ছে । আর দর্শকের সমস্ত করতালির একমাত্র ভাগিদার তুলা,কাঠের সেই প্রাণহীন সত্তা । আজ যেন প্রথমবারের মত পাপেটটি অর্জন করে নিল তার প্রাপ্য সম্মান । তার প্রাণহীন দেহের হাসিটা বুঝি তাই আরও বিস্তৃত হয়ে দেখা দিল ।

তার চোখ দুটি বন্ধ হবার আগ মুহূর্তেই দেখতে পায় পাপেটের যে হাতে ছুড়ি সে হাতের সাথে বাঁধা সুতোটা ছেঁড়া । তার নিজের রক্তেই ভিজতে থাকে তার তৈরি করা মঞ্চ । পৃথিবী কখনো কারো প্রাপ্যকে তার থেকে দূরে সরিয়ে রাখে না । যেমনটি দেখা যায় সমাজের মঞ্চেও । প্রাণ থাকা আর না থাকা তো আপেক্ষিক ! 
Credit By :  Hasin Ishraq

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা