গল্পঃ প্রজাপতির জঙ্গল যাত্রা
লেখকঃ মোঃ শাওন
শেষ পর্ব
সন্ধ্যার কিছু পূর্বেই তারা বাড়ি ফিরে আসলো।বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে কোথায় যেন মাতাল বাউলের দল গান করছে, অস্পষ্টভাবে সেই গান ভেসে আসছে বসবার ঘরে। সারাদিনের সব ঘটনা সবাই এক জায়গায় বসে আলোচনা করছেন আর সেই আসরের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে শেষের সেই গুলির শব্দ টা। হাতের ভঙ্গিতে বুঝিয়ে, চোখ দুটো বড় বড় করে রবি বলতে লাগলো-“আমার বাবা চাচারা অনেক পশু শিকার করেছেন। আমি ছোটবেলায় হরিণের চামড়া সহ আরো কত কি দেখেছি। আমার বড় চাচার কাছে তো বাঘের ঘা এর দাগ পর্যন্ত ছিল। অবশ্য তা তেমন গুরুতর বা বড় ছিল না। ওই যে বন্দুকটা দেখছেন ওটা তো সেইসময়ের চিহ্ন।“ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভূপতি বললেন- “শিকার একটা নেশা বুঝলে। তোমার বংশের এধরনের কেউ ছিলো শুনে বেশ ভাল লাগল। তবে শোনো একবার এক বন্ধুর সাথে ভারতে গিয়েছিলাম সেখানে তার কাছে শিকারের কিছু কৌশল শিখে সেখানে একটা চেষ্টা করলাম। বেশকিছু বুনোহাঁস, কিছু খরগোশ মেরেছিলাম কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে হরিণ……… তা হয়ে ওঠেনি। তার বন্দুকটায় বড্ড বেশি শব্দ হতো।“আর একটা চুমুক দিয়ে তারপর- “সেখানকার জঙ্গলে যথেষ্ট সময় কাটানোর পরে এখানে তেমন কিছু জঙ্গলের ভাব বুঝতে পারছিনা। জঙ্গলের সেই রোমাঞ্চতা অনুভব হচ্ছে না।“ ভূপতির পরের বাক্যবিন্যাস কি হতে পারে এই কথার ইঙ্গিত যেন প্রজাপতি বুঝে ফেলেছে তাই সে বলল- “এ জঙ্গলে তো শিকার করা নিষিদ্ধ, তার উপরে ফরেস্ট গার্ড এর করা আইন। কোন ক্রমেই সম্ভব না। তবে একটা কাজ করা যেতে পারে। আগামীকাল আমরা জঙ্গলের আরেকটু ভেতরে যেতে পারি। ওরা সবাই মিলে ঠিক করল যে পরের দিন তারা জঙ্গলের উত্তর দক্ষিণ কোণে ভেতর পর্যন্ত যাবে। সবাই মিলে ঠিক করল একদিন একরাত জঙ্গলে কাটানো হবে, অন্যরকম একটা অ্যাডভেঞ্চারের পাওয়া যাবে। তবে ইকবালের একটু চিন্তা হচ্ছে। জঙ্গলে খাবার-দাবার পাবে কোথায় এত। সে একমনে এটা ভাবছে আর মাথার ডান দিকটা খসখস করে হাত ঘষছে। ভূপতির চেহারায় দাবা দাবা বিজয়ীরাস ভেসে উঠলো। এই সবকিছু প্রজাপতির কাছে কেমন জানি একটু দ্রুত দ্রুত মনে হচ্ছে। সে চিন্তা করছে সে কিভাবে এত সহজে রাজি হয়ে গেল। যেখানে জঙ্গলের অনেক বিপদ তো আছেই…………। সবার উৎসুকতা দেখে, সে না যাওয়ার প্রস্তাবটা করতে চেয়ে আর করতে পারলো না ।কিন্তু নিজেকে একটু বোকার স্বরূপ অনুভব করতে লাগলো। কারণটা হলো প্রজাপতি ও ভূপতি বাদে বাকি দুজন জঙ্গল সম্পর্কে এতটা অভিজ্ঞ না।
জঙ্গলের মধ্যে সবাই একে অন্যকে অনুসরণ করে চলছে। জঙ্গলটা বেশ ঘন হয়ে এসেছে। মেহগনি, ইউক্যালিপটাস, শাল গজার, রেইনট্রি, সহ আরো নানা ধরনের জঙ্গলি গাছ। হুট করে রবি সামনে থেকে থেমে গেল তার ডান দিকে হাত ঘুরিয়ে দেখে, একটা গাছকে ধরে বলতে লাগলো-এই গাছটার অনেকগুণ বাবু।পড়ে থাকা একটা শুকনো ডাল তুলে, গাছের খানিকটা বাকল উঠিয়ে সে তার ব্যাগের মধ্যে রেখে দিল। গাছের গায়ে ছোট ছোট সাবু দানার মত লাল রংয়ের আঠা জমেছিল। অবশ্য তা রোদে শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে। এই শুকনো আঠা অ্যান্টিসেপটিক এর মত কাজ করে। জঙ্গলে বিভিন্ন রকমের ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এতে করে হাতে পায়ে নানা জায়গায় ছিলে যায়। সেজন্যই খানিকটা আঠা রবি তার সাথে নিয়ে নিল।এরমধ্যে ইকবালের খিদে পেয়ে গেছে। মনটা উসখুস উসখুস করছে। বিরক্ত নিয়ে বলল-“আমারা কি এখন একটু খাওয়া-দাওয়া করতে পারি? “
এখন না, কারণ সাথে যেটুকু খাবার আছে, তা আমাদের রাতের খাবার আর দুপুরে খাবার টা ফলমূল দিয়ে করব- প্রজাপতির মুখে এ কথা শুনে ইকবালের মুখটা কেমন বাংলার পাঁচের মত হয়ে গেল। খানিকটা পথ চলার পরে একটা গাছে কমলা ও লাল রংয়ের এক ধরনের ফল দেখে ইকবাল হাত দিয়ে দুটো ছিড়ে নিয়ে তার জামার সাথে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছে আর খুব ভালোভাবে দেখতে। চলার পথে তার এই ধরনের কাজ দেখে প্রজাপতি বলল-তুমি কি ওটা খাওয়ার কথা চিন্তা করছো, যদি এমনটা ভেবে থাকো তবে তোমাকে বলব খেওনা।কারণ ওটা খেয়ে গ্রামের লোকেরা খানিক সময়ের জন্য মাতাল হয়ে যায়।
-“ধুর, এটাকে ফেলে দেওয়াই ভালো।“তার কাজকর্ম দেখে সবাই হাসতে শুরু করে দিল।
দুপুরের খাবারের জন্য তারা একটা জায়গায় থেমেছে। জঙ্গলটা এখানে হালকা।পাশেই একটা ছোট্ট জলাশয় আছে কিছুটা পানি পান্নাসবুজ। তাতেই একটু হাত-মুখ ধুয়ে এসে সবাই বনের কিছু সংগ্রহ করা ফল খাচ্ছে। কিন্তু কোথাও থেকে একটা দাবা দুর্গন্ধ সবার নাকে ভেসে আসছে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য ইকবাল উঠে একটা গাছের পেছনদিকে গেল কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই সে একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো, তার চিৎকার শুনে সবাই হতচকিত হয়ে উঠে দৌড় দিল। এই অল্প সময়ের মধ্যেই বীর বরেন্দ্র বন্দুক নিয়ে সবার প্রথমে দৌড় দিয়েছেন। দৃশ্য দেখে তার স্তম্ভিত হয়ে গেল। একটা নয় দুটো নয় , দশের অধিক হরিণের মৃতদেহ পড়ে আছে সেখানে কেউ তাদের কে মেরেছে চামড়া আর শিং কেটে নিয়ে গেছে।পড়ে আছে শুধু মৃতদেহগুলো। এই দৃশ্য দেখে প্রজাপতির অন্তর যেন কেঁপে উঠলো তার মনের মধ্যে বারবার একটাই কথা আসছিল ,অধিক মূল্য তো তারাই চামড়া বিক্রি করতে পারবেনা মাত্র সামান্য কিছু টাকার জন্য এইভাবে এত নির্মম ভাবে এতগুলো হরিণকে তারা হত্যা করেছে এই বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষের , তাদের হত্যালীলা দেখে তার মনের মধ্যে যেন ………অন্যদিকে বাকিদের মনে এর তেমন কোন প্রভাব পরল না খুব সাধারন নিতান্ত বিষয় হিসেবে তারা এটাকে ভুলিয়ে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে গেলেন।সারাদিনে তারা অনেকগুলো বানর, কিছু বুনো শুয়োর আরো বিভিন্ন রকমের পাখি দেখলো। ইকবাল যেন প্রতিটা জিনিস কে একেবারে নতুন করে নবজাতকের মতো আবিষ্কার করতে লাগলো। তার ভারী আনন্দ হচ্ছিল এই জঙ্গল যাত্রায়।
সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তের শেষভাগে, আর বেশি সময় নেই অস্ত যেতে। সে যেন ধীরে ধীরে নুয়ে পড়ছে বনের ভেতরে , তাতে যেন ধীরে ধীরে ক্রমে জঙ্গলের মধ্যে এক অন্ধকার নেমে আসছে। চারিদিক ধীরে ধীরে থমথম করে উঠতে লাগলো। সবাই মিলে একটা হালকা তাবু তৈরি করে রাতটা সেখানেই কাটানোর পরিকল্পনা করলো, তারপর তিন দিকে তারা হালকা ডালপালা দিয়ে একটা বেষ্টনী তৈরি করে রাখল, যাতে করে কোনো জন্তু-জানোয়ার রাতে তাদের কাছে ভিড়তে না পারে। পাথরে পাথরে ঘষে প্রজাপতি একটা আগুন জ্বালিয়ে রাখল এবং সারারাত যাতে আগুনটা জলে সেই জন্য এক এক করে পাহারায় থাকবে তারা। সঙ্গে রাখা কিছু খাবার তারা আগুনে ঝলসিয়ে নিচ্ছে। সুন্দর জ্যোৎস্নার আলোয় পুরা বনটা যেন এক অন্যরকম অপরূপ সৌন্দর্য প্রদর্শন করছে। চারিদিক অন্যরকম ভাবে জেগে উঠেছে। নিশাচর প্রাণীর আনাগোনা ক্রমেই বাড়তে লাগলো। কোন দিকে ঝিঝির ডাক আবার কোথাও কোথাও জোনাকির দল উড়ে যাচ্ছে। অদূরে কোথাও কোন এক জংলি ফুলের মিষ্টি সুবাস চারিদিক যেন সুরভিত করে রেখেছে।
প্রজাপতির চোখ বাঁচিয়ে এরই মধ্যে চোখে চোখে ভূপতি সরকার ও বীর বরেন্দ্রর কোন একটা মতবিনিময় হয়ে গেল যা কেবলমাত্র তারা দুজনেই বুঝতে পারলেন। আগুনে খাবার ঝলসাতে ঝলসাতে ভূপতি বললেন
-রবি, কখনো হরিণের মাংস খেয়েছো? শুনেছি খুব নাকি সুস্বাদু হয়।
-“কি যে বলেন বাবু,ছোটবেলায় অনেক খেয়েছি। এখন তো আর মারতে দেয় না। না হয় আপনাদের খাওয়াত”।
এই সবকিছুর মাঝে কিন্তু ইকবালের বুক ধরফর করছে সে বলে বসল- “আচ্ছা ভাই বাঘ আসবে নাতো এ রাত্রে কোথা থেকে খাপটি মারে কে জানে।“তার কথার রাশ টেনে ভূপতি ও বরেন্দ্র একসাথে বলে উঠলেন “বাঘ আসলে তার রক্ষা নেই, নির্ঘাত মৃত্যু আর তার চামড়া আমার বাড়ির দেয়ালে।“ -বলে একটা অট্টহাসি দিয়ে দিলেন। সুন্দর জোসনা আলোর মধ্যে বসে সবাই গল্প করছে আর রাতের খাবার উপভোগ করছেন। যদিওবা সেই খাবারে লবণ নেই ঝাল নেই কিন্তু সারাদিন একটা পরিশ্রম করার পর, হাটবার পর খাবারের তৃপ্তিটা যেন আর অন্যান্য খাবারের চাইতে একটু বেশি মনে হচ্ছে সবার কাছে। দুপুরের দেখা হরিণগুলোর করুণ পরিস্থিতি নিয়ে সবাই কথা বলছে সে কথার রেশ টেনে প্রজাপতি বলল-“হরিণ। সবার কাছে যখন সময় আছে একটা ছোট গল্প বলি। আজ থেকে প্রায় বছর ১৪-১৫ আগের কথা। তখন দাদু বেঁচে ছিলেন সেইটাই শেষবার, যখন আমি এই জঙ্গল দেখতে এসেছিলাম। তারপরে এই এখন আসলাম। অবশ্য তখন জঙ্গলের প্রথমাংশ পর্যন্ত এসেছি এত ভিতরে আসা হয়নি।“
স্মৃতির অতল গহবর থেকে স্মৃতিগুলোকে তুলে প্রজাপতি বলল-“তখন আমি আর দাদু বেরিয়েছিলাম বন ঘুরবো বলে। অনেক বায়না করে বের হয়েছিলাম, বেশ ভালো লাগছিল , সব সময় শহরের জঙ্গল দেখে দেখে চোখ গুলো ঝলসে গিয়েছিল কিন্তু যখন এই তল্লাটে এই জঙ্গলের প্রথম দৃশ্যটা চোখের সামনে উদয় হলো তখন মনের মধ্যে অনেক ভালো লাগছিলো। বাতাসের মধ্যে কোন দূষণ না থাকায় নিঃশ্বাস নিতে যে এত আরাম লাগে তা আমার তার আগে কখনো উপলব্ধি হয় নাই। ঘাস ফড়িং আর অন্যান্য সব পাখিদের উড়তে দেখে আমার মনের মধ্যে অনুভব হলো আমি জানো পাখি মত হালকা হয়ে গেছি, দুই হাত মিলিয়ে দিয়ে পাখির মত উড়ার চেষ্টা করছিলাম , একদৃষ্টে বসে থেকে উড়ে যাওয়া অসংখ্য পাখির যাত্রা দেখছিলাম, সব মিলিয়ে মনের মধ্যে অন্যরকম এক ভালো লাগা কাজ করছিল। জঙ্গলের এই দিকটায় হরিণ দেখা যেত , থেকে থেকে হরিণের পাল বিচরণ করতো এই ঘাসের ভূমি।হাতে একটা ছোট্ট ডাল নিয়ে হাঁটু সমান গাছগুলোকে হেলিয়ে দিয়ে আমি সবার আগে আগে হাঁটছিলাম আমার পেছনে দাদু।তখন হঠাৎ দেখি একটা হরিণের ছোট বাচ্চাকে একটা গাছের সাথে বেঁধে রেখেছে কোন একজন আর একটা আমার চেয়ে বয়স অল্প বড় ছোকরা হাতে একটা দোনালা বন্দুক দিয়ে তার সাথে থাকা বড় লোকটা তাকে বলছে- “গুলি কর ওকে। শিকারি ছেলে তুই মারতে তোর এত ভয়।“আর ছককাটা বারবার বলছিল- “দেখো ওকে, কত ছোট সে, তার শরীরে কিসের মাংস পাওয়া যাবে , না , ওকে মেরে কি হবে ছেড়ে দি। আমি পারবো না।” বলে সে হাতের বন্দুকটা ফেলে দিল। আমার বেশ মায়া হচ্ছিল, কত সুন্দর তার মায়াবী মুখ। ছোট ছোট সিং। সে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে আর বারবার আমার দিকে আর চোখের দিকে তাকাচ্ছে। জানি সে কিছু বুঝতে পারছে। আর সেই নম্র চাহনিতে যেন আকুতি মিশ্রিত করা আছে, যেন সে আমাকে বলছে আমাকে বাঁচাও। যেন তার অব্যক্ত ভাষা আমি বুঝে ফেলেছি। সে আমাকে বলছে কি দোষ আমার। আমি তোমার চেয়ে কম বলিষ্ঠ এটাই আমার দোষ? আমি সুন্দর চামড়া, সুন্দর সিং, মায়াবী চোখ নিয়ে জন্মেছি এটাই কি আমার দোষ। তার প্রতি আমার মায়া যেন বেড়েই চলেছে। দাদুকে বললাম ওকে মারতে মানা করো। দাদু ,ওকে আমার চই , এত সুন্দর একটা প্রাণী এইভাবে নির্বিচারে হত্যা করবে তা হতে পারে না্ ,ওকে বাঁচাও। শেষপর্যন্ত দাদুর সাথে ওই শিকারির অনেক কথাবার্তার পরে তারা হরিণটাকে আমার হাতে সোপর্দ করল। সেদিন তার সাথে অনেক খেলেছিলাম। কিছু সময়ের মধ্যে সে আমার ওপর ভরসা করতে লাগলো । পরের ৫-৬ দিন আমি এখানেই ছিলাম প্রতিদিন আসতাম তার সাথে একটু একটু খেলতাম। সাথে রাখা রুটি তাকে খাইয়েছিলাম। সময়টা অনেক সুন্দর গিয়েছিল। যেদিন চলে যাব সেদিন বনের প্রথম ভাগটায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখি অনেকগুলো হরিণ সহকারে সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তার গলাতে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না পাচ্ছিল। পরে অনেকটা সময় একসাথে কাটানোর পরে সে বনের মধ্যে দিয়ে দিয়ে চলে গেল ।“
এই কথা বলে প্রজাপতি সেখান থেকে উঠে একটু সামান্য আগে হেঁটে চলে গেল।প্রজাপতির কথাগুলো যেন ভূপতির কাছে মূল্যহীন তার কথাগুলো শুনে ভূপতি একটু দম্ভ নিয়ে বলল- “এটা হল দুর্বল হৃদয়ের কর্ম, এতটা দুর্বল হওয়া আমার কাছে একটু অর্থহীন”।
আগুনে এক টুকরো কাঠ ফেলে দিয়ে একটা হাসি সহকারে রবি বলে উঠলো –“সেই ছোকরাটা আর কেউ নয়, আমি। আমার হাতেই সেদিন বন্দুকটা দেওয়া হয়েছিল। পরে আমার বাবাকে বড়বাবু বুঝিয়ে বলেন যে, শুধু খাওয়ার জন্য এত সুন্দর প্রাণীর চামড়া বিক্রি করা মোটেও ভালো কাজ না এবং আমার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বড়বাবু নিয়ে নেন। তারপর থেকেই বড় বাড়ির সব দায় দায়িত্ব আমার। প্রথমে টুকটাক বাজার আনতাম ধীরে ধীরে বাড়ির সব কাজ কর্মের দায় দায়িত্ব আমার কাছে দিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই কেটে যাচ্ছে আর আমি যথেষ্ট ভালো আছি বাবুদের সাহায্যে।“এক মুহূর্তের জন্য হতচকিত হয়ে গেল সবাই।
চারিদিকে কৃষ্ণপক্ষের রাত নেমে আসছে। আকাশের টুকরো টুকরো মেঘ ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ চাঁদকে ঘিরে ধরেছে। অদূরে কোথাও ভুতুম পেঁচার ডাক যেন বেড়েই চলেছে। জঙ্গলের ভেতর মৃদু মৃদু বইছে হিমেল বাতাস।গাছে গাছে ঘর্ষণ, শুকনো পাতার মরমর শব্দ যেন জঙ্গলের মৃদু নাসিকা গর্জনের নেয় নিস্তব্ধতাকে কাটিয়ে তুলছে।
পরদিন সকলে তোড়জোড় নিয়ে বের হলো। আশেপাশে কোথাও হরিণের দল আছে। হরিণের পায়ের ছাপ, সদ্য ত্যাগ করা মলের গন্ধের কারণে তা খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে। মাথার উপরে প্রচন্ড কড়া রোদ। চারি দিকের পরিবেশ তামাটে হয়ে উঠেছে। একটু একটু করে সকলের মধ্যে থেকে শক্তি যেন নিংড়িয়ে নিচ্ছে দুষ্টু সূর্যটা। বীর বরেন্দ্র একটু চনমনে হয়ে উঠেছে থেকে থেকে চারিদিকটাকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সকলেই ঘাস বনে এসে পৌঁছেছে।
বীরেন্দ্র প্রজাপতির সাথে চোখ মেলাচ্ছে না, দ্রুতপদে প্রজাপতি কে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে কিন্তু ভূপতি সরকার তাকে চোখের ইশারায় কিছু একটা বোঝাচ্ছেন এসব দেখে ইকবালের মনে উসখুস উশখুশ ভাব।
হঠাৎ বির বরেন্দ্র বন্দুকটাকে তাক করে ধরল। দীর্ঘ গলায় বলল-‘স্থির হয়ে যান’। বীর বরেন্দ্রের কথা মোতাবেক সবাই স্থির হয়ে গেল। কিন্তু কিসের দিকে সে বন্দুক তাক করেছে? কি আছে ওই দিকে। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রজাপতি দেখবার চেষ্টা করলো। হতচকিত সে, এটাতো একটা হরিণ। মুহুর্তের মধ্যে প্রজাপতি ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার বুকের মধ্যে ফুরফুরা নি বেড়ে গেল।সে জোরে একটা আওয়াজ করল।আওয়াজ শুনে হরিণটা দৌড়ে পালিয়ে গেল। সাথে সাথেই এক দৌড়ে ভূপতি এসে বীর বরেন্দ্রর হাত থেকে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিলেন এবং বললেন-“এটা হরিণ দলপতি, একে শিকার করা যাবে না। শিকারের কিছু নিয়ম আছে। আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলাম। আমি সকাল থেকেই তোমাকে মানা করছি। এই বনে হরিণ শিকার করোনা।এমনিতেই অল্প কয়েকটা হরিণ এখানে জীবিত আছে।“
বীর বরেন্দ্র এমন একটা কাজ করতে পারে তার কোনো আশঙ্কাই প্রজাপতির মনে ছিলনা।সে মনে মনে খুব ব্যথা পেল।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বীর বরেন্দ্র কে বলল-“আমি তোমার কাছে এটা আশা করেছিলাম না’।কথাগুলো বলছে এমন সময় ইকবাল প্রজাপতির পেছন থেকে তার জামাটাকে টেনে কিছু একটা ইঙ্গিত করছে সে কিছু একটা বোঝাতে চেষ্টা করছে আমতা-আমতা জরানো ভাষায় কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছে।জড়ানো স্বরে বলল-“ঘুরে দেখো প্রজাপতি ওটা কি।“
ঘাসের বনকে ছিঁড়তে ছিঁড়তে।বাতাসকে নিস্তব্ধ করে দিয়ে।ছলছল চোখ নিয়ে একটা হরিণ তাদের দিকে দেখছে। মুহূর্তের মধ্যেই বনের মধ্যে যেন সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেল। চারদিকে কোন শোরগোল নেই। পাখিরা আনন্দের সুরে ডাকছে। সে যেন এক অন্যরকম কথা, আকাশে বাতাসে পাখির সুরে মহামিলনের সন্ধিক্ষণ ঘনিয়ে আসছে। একটা একটা পা করে প্রজাপতি এগিয়ে যাচ্ছে সেই হরিণ টার দিকে। ছল ছল চোখ,মায়াবী চেহারা , এঁকেবেঁকে উপরের দিকে উঠে গেছে একজোড়া সিং। তপ্ত রোদের আলোতে জ্বলজ্বল করে জলছে গায়ের সৌন্দর্য। যেন একটা একটা করে তপ্ত রোদে জ্বলছে আকাশের তারা। সবাই তনময় হয়ে সেই সেই দৃশ্যের প্রতি তাকিয়ে আছে। হরিণটার একবারে কাছে এগিয়ে যেতেই, হরিণটা প্রজাপতির দিকে অগ্রসর হল। নিজের নাক ও মুখের সাথে প্রজাপতির হাত স্পর্শ করালো। কিছু একটা বুঝতে চাইছে সে। যেমনটা অতি পরিচিত কোন বন্ধুর আগমনে হয়। প্রজাপতি মুহূর্তের মধ্যেই তার সেই পরিচিত বন্ধুকে বুঝতে পারল। একদিন করা সাহায্যের প্রতিদান স্বরূপ তাকে সে আজও মনে রেখেছে। তার স্পর্শে যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে , সে তার বন্ধুত্বকে আজও ভোলেনি। মুহূর্তের মধ্যেই সেখানে জেগে উঠলো আরো অনেক হরিণের অস্তিত্ব। তাদের দলপতিকে একজন মানুষের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের সবার ভয় কেটে গিয়েছে। এভাবে খানিকটা মুহূর্ত স্থির হয়ে কেটে গেল।তাদের চাহনিতে যেন সম্পূর্ণ বন্ধুত্বের পরিচয় তারা পেয়ে গেল। খানিক সময় পরে একপা একপা করে হরিণ তার দল নিয়ে বনের মধ্যে হারিয়ে যেতে লাগলো।
প্রজাপতির জঙ্গল যাত্রা |
কিন্তু তারপরও মুহূর্তেই যে ঘটনাটা ঘটলো তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ প্রজাপতি তার দল নিয়ে সামনে এগোতেই কিছু একটা দেখেছি স্তব্ধ হয়ে গেল। তার বুকের ভেতরের হৃদপিণ্ড যেন বুকের পাঁজর জুড়ে জোরে আঘাত করছে। মুহূর্তের মধ্যেই তার চঞ্চল চোখ কোন একটা বস্তুর প্রতি স্থির হয়ে গেল। কি ওখানে। নানারকম প্রশ্ন তার মনের মধ্যে আনাগোনা করতে শুরু করলো। হাতের ইশারায় সবাইকে কিছু একটা বোঝাতে চেষ্টা করছে। ভূপতি সরকারের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। যেন চোখের কোটর ভেদ করে বাইরে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। সম্পূর্ণ বন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কোথাও একটা শব্দ পর্যন্ত নেই। কিছু সময় পূর্বে এই বন যেন জাগ্রত ছিল, এখন সবকিছু নেতিয়ে পড়েছে। ইকবাল কিছু একটার ভয় পেয়ে দুইহাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বীর বরেন্দ্র চিবুক শক্ত করে ধীরে ধীরে তার বন্দুকটা কাঁধে উঠিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ঘাসের সাথে মিশে থাকা দুটো চোখ দেখা যাচ্ছে। এই চোখ রবির অতি পরিচিত। এক হুংকার দিয়ে বনের ভেতর থেকে লাফিয়ে পড়ল একটা বাঘ। মূহুতের মধ্যেই সেখানে নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল। হাতে থাকা দোনালা বন্দুক তা চালাতেই ছিটকে চলে গেল বন্দুকটা। বন্দুকের গুলি তার লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। বাঘটাকে শুধু পায়ে ঘায়েল করেছে মাত্র। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সবাই তার জীবনের সেই অংশটা মারাতে প্রাণপণে দৌড় দিল। কিন্তু বাঘ তাদের পিছু ছাড়েনি। সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে তাদের পেছনে ধাওয়া করলো। সবার পেছনে প্রজাপতি। বাঘটা তার থেকে সামান্য দূরে। কিছু একটা তো হোঁচট খেয়ে তার গতি অবরুদ্ধ হল। এই মন্থরগতিতে বাঘ তার উপর ঝাপিয়ে পড়বে এমন সময় সে দেখে সামনে থেকে দৌড়ে আসছে কিছু একটা। এটাতো একটা হরিণ, এক মুহুর্তে তাকে পাশ কাটিয়ে সোজা চলে গেল বাঘটার দিকে। মুহূর্ত স্থির হয়ে সে প্রজাপতির সমান গতিতে প্রজাপতির সাথে দৌড়াতে শুরু করলো। একবার প্রজাপতি ও হরিণের দৃষ্টি বিনিময় হলো। তারপর মুহূর্তেই হরিণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সহজ শিকার দেখে বাঘ লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পরলো হরিণের উপরে। এর মধ্যেই তারা সবাই ফরেস্ট গার্ডের গাড়িতে লাগিয়ে উঠে পড়েছে। পিছন ঘুরে প্রজাপতি দেখে। হরিণটা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এক মুহূর্তের মধ্যেই বাঘ হরিণকে মাটিতে ধরাশায়ী করে দিল। তার উত্তপ্ত রক্ত যেন গড়িয়ে পড়ল বনের তামাটে ঘাসের মধ্যে। প্রজাপতির মনে শুধু একটাই প্রশ্ন জাগলো আমাকে বাঁচানোর জন্যই কি হরিণটা তবে নিজেকে বাঘের সহজ শিকারে পরিণত করল।
ভূপতি সরকার অস্পষ্ট গলায় বললেন-‘আজ প্রকৃতি অন্যরকম এক সাক্ষী হলো।‘
সমাপ্ত
Credit By : Mohammad Shawon
0 মন্তব্যসমূহ