হাসি , কান্না , আবার হাসি

হাসি , কান্না , আবার হাসি 
লেখক ঃ লিঙ্কন হাসান 


- আন্টি কি করছেন ?
- গবেষণা করি ।
-
কিসের গবেষণা ?
-
আলো এবং অন্ধকার বিষয়ক গবেষণা ।
-
আলো এবং অন্ধকার নিয়ে গবেষণা !?
-
হুম ।
-
বাহ , বেশ ইন্টারেস্টিং তো ! আমি কি জানতে পারি বিস্তারিত ?
-
পারিস । দশ মিনিট পরে আয় । এখন আমার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটাস না ।

আমি আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম । আন্টি বিশাল উঁচু মাপের গবেষক । তার আরেকটা পরিচয় আছে । আমার বাড়িওয়ালী । তার বাড়িতে দীর্ঘ চার বছর যাবৎ ভাড়াটে হিসেবে আছি । চিলেকোঠায় থাকি । তিন হাজার টাকা ভাড়া । আমি রুম শেয়ার করে থাকি । আমার রুমমেট এই বাড়ির ড্রাইভার । তার নাম মতিনুজ্জামান । আজ ২৩ জানুয়ারি , এখনো ভাড়া পরিশোধ করা হয় নি । ভাড়ার ব্যাপারে কথা বলতেই আন্টির রুমে গিয়েছিলাম ।
দশ মিনিট পর আবার আন্টির রুমের দিকে পা বাড়ালাম । এবার বরং অনুমতি নিয়েই ঢুকি ।
-
আন্টি আসবো ?
-
কে ?
-
আমি , আন্টি ।
-
হ্যাঁ , ভেতরে আয় ।

আন্টি ধীরেধীরে কপাল থেকে হাত নামালেন । দেখেই বুঝা যাচ্ছে তিনি কোনো জটিল বিষয় নিয়ে চিন্তা করছেন । আলো-অন্ধকার । গবেষক মানুষ ।
-
কি ব্যাপার , তুই তো এখনো এই মাসের ভাড়া পরিশোধ করিস নি ।
-
জ্বি আন্টি , ভাড়ার ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছিলাম । তবে তার আগে আমি আপনার আলো-অন্ধকার নিয়ে গবেষণার বিষয়টা জানতে চাই । আমি অত্যন্ত আগ্রহী ।
-
আসলে , আমি এখনো এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারি নি । এমনকি আংশিক সমাধানও পাই নি । ব্যাপারটার বিশ্লেষণ বের করার পর তোকে বলবো । খুব জটিল বিষয় ।
-
আন্টি , এই যে ভাড়ার টাকাটা ।
-
এক হাজার কেনো ? গতো মাসেও তো তুই ভাড়া কম দিয়েছিস । তাছাড়া মতিনুজ্জামান বলেছে , সে তোর কাছে তার ভাগের দেড় হাজার টাকা দিয়েছে পরশু দিন । তুই আমাকে দিবি মোট তিন হাজার ।
-
আন্টি হয়েছে কি , আমি গতো রাতে স্টেশন থেকে ফিরছিলাম । হাড় কাঁপানো শীত পড়েছিলো । এতো মোটা কাপড় পরেও আমি ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিলাম । তখন কিছুদূর এগিয়ে একটা মর্মান্তিক দৃশ্যের সম্মুখীন হলাম । স্টেশনের এক কোণায় তিন জন বৃদ্ধলোক একটা পাতলা কম্বল জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে বসে ছিলো । খুব পাতলা কম্বল আন্টি । তাও একি কম্বলে তিনজন । অসহায় , হতদরিদ্র লোক । দেখেই আমার চোখ ভিজে গেলো । তারপর তাদেরকে নিয়ে মার্কেটে গেলাম । মোটা দেখে সবাইকে শীতবস্ত্র কিনে নিজের হাতে পরিয়ে দিলাম । তারা খুব খুশি হয়েছিলো আন্টি । সেখানেই ভাড়ার টাকাটা খরচ করে ফেললাম ।
আন্টি কিছুক্ষণ যাবৎ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন । হুট করে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
-
এজন্যই তোকে আমি নিজের ছেলের মতো স্নেহ করি । দোয়া করি তুই জীবনে অনেক বড়োহ’ । আর মাসের ভাড়া এক হাজারেই চলবে । আর দিতে হবে না ।
আমি বিজয়ের হাসি হাসলাম । আসলে বৃদ্ধদের শীতের কাপড় কিনতে আমার মাত্র সাতশো টাকা খরচ হয়েছিলো । গায়েব করে দিলাম দু হাজার ।
আন্টি সত্যিই আমাকে অনেক স্নেহ করেন । অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ । হৃদয়টাও বেশ তরল । তার একটা বিশেষ গুণ হচ্ছে , তিনি পরোপকারী । অন্যের কষ্টে নিজেই বেশি ব্যথিত হন ।
- ওহ্ ভালো কথা মনে পড়েছে , তুই কালকে মতিনুজ্জামানকে সারারাত বাথরুমে আটকে রেখেছিলি কেনো ?
কাজ সারছে । ড্রাইভার বেটা এই বার্তাও ইতোমধ্যে পৌঁছে দিয়েছে । মস্তিষ্কটাকে দ্রুত তাড়া করছি , কিছু একটা বলে রেহাই নিতে হবে । কিন্তু কোনো অজুহাতই খুঁজে পাচ্ছি না । মুশকিল ।
-
ওর সাথে এমন ব্যবহার করবি না কখনো । বেচারা গ্রামের মানুষ । একটু বোকা আছে বটে । আর যদি এমন শুনি , তাহলে থাপড়াতে থাপড়াতে বের করে দেবো । বদমাইশ ছেলে ।
আমি মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে আছি , যেনো এই পৃথিবীতে মাত্রই অবতরণ করলাম । এমন এক্সপ্রেশনে আমার চেহারায় ইনোসেন্ট ভাব আসে । আয়নায় দেখেছি।
-
যা , এখন দূর হ।
-
আন্টি ? আর হবে না এমন ।
-
ঠিকাছে যা তুই । তোকে এখন সহ্য হচ্ছে না ।
-
আন্টি ?
-
কি ?
-
কিছু না ।

আন্টির দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি । খুব করুণ ।
- কিছু বললে বল , নইলে দূরহ’ । আমি গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে যাবো । অত্যন্ত জটিল বিষয় নিয়ে গবেষণা করছি । বহুদিন ধরে ভাবছি বিষয়টা নিয়ে ।এবার একটা সুরাহা বের করেই ছাড়বো ।
-
আন্টি আমার হাত খরচা নেই । আপনার হাতে যে একহাজার টাকার নোটটা , ওটাই শেষ সম্বল ছিলো ।
-  
এটাও হজম করে ছাড়বি ? ঠিকাছে , নিয়ে যা । এখন আর বিরক্ত করিস না । গবেষণা করতে দে আমাকে ।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি টকটক করে । ড্রাইভারের উপর বেশ রাগ হচ্ছে । দেখতে হাবলুর মতো হলেও বেটা নালিশ করাতে ওস্তাদ।  চিলেকোঠার রুম , এমনিতেই ভয় ভয় করে । তার উপর নাক ডাকার শব্দ । যেনো পাশে কোথাও কেউ গরু জবাই করছে । বাথরুমে আটকে রাখবো না তো করবো টা কি । এটাই তার উচিৎ শিক্ষা ।
সপ্তাহ খানিক পর আন্টি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন । প্রচণ্ড জ্বর । বুকে ব্যথা । আমার ভেতর কেমন যেনো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো । আন্টি এখন হাসপাতালে ভর্তি । আমার কিছু ভালো লাগছে না । আন্টির অসুস্থতার খবর শুনে তার দুই ছেলে এবং একমাত্র মেয়ে এসে হাজির । সবাই বিয়ে করে চাকুরীর অযুহাতে এখন বিদেশে পারি জমিয়েছে । আন্টিকেও অনেক জোর করেছিলো বিদেশে নিতে । কিন্তু তিনি বেশ নাছোড়বান্দা । কিছুতেই দেশ ছাড়বেন না । বাড়িতে এখন অনেক লোকজন । তা প্রায় বারোচোদ্দ জন তো হবেই । দু ছেলের বউ , মেয়ের জামাই , কাচ্চাবাচ্চা । এতো লোকের সমাগমেও বাড়িটা আমার কাছে কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে । লাগাটাও স্বাভাবিক । এই বাড়ির সবচে বড়ো অলংকার এখন হাসপাতালে । খুব বিষণ্ণ লাগছে আমার । আমি উঠে শার্ট গায়ে দিলাম । হাসপাতালের দিকে যাচ্ছি , আন্টির কাছে ।
তিনি এখন আগের চেয়ে সুস্থ । আন্টিকে দেখে মনটা বেশ ফুরফুরে হলো । নিচে নেমে দেখি মতিনুজ্জামান গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।
-
মতিনুজ্জামান চলো , আমাকে নামিয়ে দিয়ে এসো ।
-
বড়ো সাহেবের বউ এসেছে । উনাকে নিয়ে যেতে হবে ।
-
ঠিকাছে আমি তাহলে একটু অপেক্ষা করি । দুজন একসাথে চলে যাবো ।
ড্রাইভার কিছু বললো না । সে অবশ্য আমার উপর তেমন খুশি না । মনে মনে রাগ করে আছে । আমি গাড়িতে উঠে পেছনের সিটে আরাম করে বসলাম । এর মধ্যেই বড় সাহেবা হাজির । শুনেছি সে খুব বদমেজাজি ।
-
এই যে , আপনি সামনে গিয়ে বসুন । আমি পেছনে একা বসবো ।
আমি কপাল কুঁচ করে ড্রাইভারের সাথে সামনে গিয়ে বসলাম ।
বড়ো সাহেবা ড্রাইভারকে নাম জিজ্ঞেস করলেন ।
-
ড্রাইভার সাহেব , নাম কি আপনার ?
-
মতিনুজ্জামান , ম্যাডাম ।
-
এতো বড়ো নাম ? ডাক নাম কি ?
ড্রাইভার কিছু বলার আগেই আমি বানিয়ে একটা ডাকনাম বলে দিলাম ।
ওর ডাকনাম সোনা । মতিনুজ্জামান সোনা ।
বড়ো সাহেবা আমার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন । বিপদ সংকেতময় চাহনি ।
একটা কৌতক থেকে ডাকনামের ব্যাপারটা মাথায়
এসেছে । রিডার্স ডাইজেস্ট ম্যাগাজিনের বাছাইকৃত একটা কৌতক । কৌতকে ড্রাইভারকে তার মনিব জিজ্ঞেস করেছিলো-
-
নাম কি তোমার ?
-
ম্যাডাম , আমার নাম চার্লস ।
-
ডাক নাম নেই ? এই নামে ডাকতে পারবো না ।
-
আছে ম্যাডাম । ডার্লিং । চার্লস ডার্লিং ।
তারপর তিনি সবসময় ড্রাইভারকে চার্লস নামেই ডেকেছেন । ডাকনামে ডাকা হয় নি কখনো ।
আন্টি বাসায় ফিরেছে দু দিন হলো । এখন পুরোপুরি সুস্থ । ছেলেমেয়ে সবাই গতকাল বিদেশে পারি দিয়েছে । অল্পস্বল্প ছুটি নিয়ে দেশে ফিরে তারা । আন্টি আমাকে ডেকে পাঠালেন । রুমে গিয়ে দেখি তিনি কাঁদছেন । তাকে কান্নারত অবস্থায় দেখে আমি থমকে গেলাম । ফুঁপিয়ে কাঁদছেন তিনি । আমার উপস্থিতিতে চোখ মুছে কিছুটা শান্ত হলেন । আমি চুপচাপ তার সামনে বসে আছি । কি বলবো বুঝে উঠতে পারছি না ।
- জানিসই তো , তোর কাকা আমাদের ছেড়ে অনেক আগেই উপরে চলে গিয়েছে । একা একা বহু কষ্টে তিন তিনটে সন্তানকে মানুষ করেছি আমি । শিক্ষিত করেছি । কিন্তু কখনো ভাবি নি , শিক্ষা যে আমার কাছ থেকে তাদেরকে কেড়ে নেবে । অনেক দূরত্ব সৃষ্টি করবে । আমি এখন তাদের কাছে অফিসের কাজের মতো একটা দায়িত্ব হয়ে পড়েছি । অসুখ হলে দেখতে আসবে । নিয়ম করে ফোন করবে । কি খেয়েছি , কখন খেয়েছি , কি পরছি না পরছি , কিছু লাগবে কি না , ওষুধপাতি রেগুলার নিচ্ছি কি না- এসব জিজ্ঞেস করবে । টাকা পাঠাবে মোটা অংকের । ব্যস , মায়ের দায়িত্ব ফুরালো । কিন্তু আমার যে ইচ্ছে করে তাদের সামনে বসে দু মুঠো ভাত খেতে , মাথা ছুঁয়ে আদর করে দিতে । তাদের হাসিমুখ দেখতে । আমার ইচ্ছে করে নাতিনাতনিদের সাথে বসে খেলাধুলা করি , তাদের কাছাকাছি থেকে শিশুদের মতো আনন্দ করি , হেসে উঠি । হবে না কিছুই জানিস ।
আন্টি কাঁদতে কাঁদতে কথা গুলো বলে শেষ করলো । আমার চোখও না কেঁদে পারে নি । আমার চোখে জল গড়াচ্ছে অনবরত । আন্টিকে জড়িয়ে ধরেছি শক্ত করে । তিনি কেঁদে কেঁদে বলছেন-
-
তুইও আমাকে ছেড়ে চলে যাবি না তো ? বেশ তো শিক্ষিত হচ্ছিস ।
-
না আন্টি কখনো যাবো না । আমি ভেবেছি , একটা চাকরীর ব্যবস্থা হলেই দক্ষিণের খালি রুমটা আমি নিয়ে নেবো । আব্বা আম্মাকে নিয়ে আসবো ।
-
আজকেই ফোন করে নিয়ে আয় না ।
-
আন্টি এখন তো এতো ভাড়া শোধ করতে পারবো না ।
-
হয়েছে হয়েছে , তুই তো খুব ভাড়া দিস আমায় । সব ভাড়া হিসেব করে একসাথে দিস পরে । আজকেই ফোন কর বাড়িতে ।
-
জ্বি আন্টি । করবো । আন্টি , একটা কথা....
-
বলে ফেল ।
-
আপনার আলো-অন্ধকার বিষয়ক গবেষণা কতদূর ?
-
ওহ্ ! হুম হুম , আবার শুরু করবো । এতোদিন তো অসুস্থ ছিলাম । এখনো কোনো বিশ্লেষণ পাই নি , তবে আজকে তোকে শেয়ার করবো ব্যাপারটা । তবে একটা শর্ত আছে ।
-
কি শর্ত ?
-
সমাধান না করা অবধি কাউকে বলতে পারবি না ।
-
জ্বি আচ্ছা । আপনি নির্দ্বিধায় বলুন ।
-
ঠিকাছে । ধর , এখন রাত বারোটা বাজে । এই রুমের সবকটা দরজা জানালা বন্ধ । লাইটও অফ করা । কেমন হবে ?
-
কেমন আর হবে , অন্ধকার হয়ে যাবে রুমটা ।
-
তারপর যদি সুইচ টিপে লাইট জ্বালিয়ে দেই হঠাৎ ?
-
তাহলে আলোকিত হবে ।
-
এখানেই তো রহস্যটা । দরজা বন্ধ , জানালা বন্ধ , একটাও ছিদ্র নেই দেয়ালে , তাহলে লাইট জ্বালাতেই অন্ধকারটা পালিয়ে যায় কোন দিক দিয়ে !
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভাবছি , আন্টি বিরাট উঁচুমাত্রার গবেষক । তার গবেষণা লেভেল আকাশচুম্বী । বাহ্ ! গর্বে বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার ।



The End 



Linkon Hasan 

Writer Information : 

Writer Name : Linkon Hasan 

Places He's Lived =>

 CURRENT CITY AND HOME TOWN


·         Nationality:  Bangladeshi (By Birth)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা