স্বপ্নের চাকরি

 

স্বপ্নের চাকরি

লিখা : মনিরুল ইসলাম (স্যার)

 

আমার ইচ্ছে  ছিলো ঢাকা কলেজে পড়বো । মা কিছুতেই রাজি না ।  আমি আর বাবা মিলে মাকে বোঝাই । অতঃপর , উচ্চ মাধ্যমিকে মানবিক বিভাগে  ভর্তি হই ঢাকা কলেজে ।

 

কলেজে বেতন দেয়া লাগে না ।  তবে থাকা-খাওয়ার খরচ তো আছে । কখনও ধান-পাট, কখনও বা সুদে ধার করে  আমার  খরচ দেন আমার  বাবা-মা । কোনো কোনো সময় জমি বন্ধক রেখেও টাকা দিতে হয় । এরই মধ্যে আমার  কলেজ জীবন  শেষ  হয় রেজাল্ট দেখে সবাই বোঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হবে । বাড়িতে গেলে আমি মাকে বোঝাই ইংরেজির প্রফেসর হবো ।  ইংরেজিতে ভর্তিও হয়ে যাই ইতোমধ্যে বড়  বোন  পাস করে স্কুলে মাস্টারি নিয়েছে । স্বামীর ঘর করলেও সংসারে কমবেশি সাহায্য করে ।

 

আমি  হলে থাকি  (সাউথ হল ১০৮ নং কক্ষ ) , মাঝে মাঝে টিউশনি করি ।  বাসায় বাসায় কলিং বেল টিপে পরের ছেলে-মেয়েকে পড়াতে কার ভালো লাগে,তবুও করতে হয় ।

 

মাঝে মাঝে টিউশনি ছেড়ে দেই , মাকে চিঠি  লিখি এর-ওর হাত দিয়ে বাড়ি থেকে টাকা আসে । সঙ্গে মাত্রা টেনে টেনে গোটা হাতে লেখা মায়ের চিঠিটাকার চিন্তা করিও না, ভিটেবাড়ি বিক্রি করে হলেও তোমাকে পড়াব আমি  আবার টিউশনি খুঁজে নেই । গুলশান-বনানীতে ধনী লোকের বাড়িতে পড়াতে গিয়ে ভাবি  আমার  নিজের  ছেলেমেয়েরাও কি এসব বাড়িতে টিউশনি করবে ?

 

সরকার পতনের দাবিতে হরতাল-অবরোধ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়, হল ভ্যাকান্ট হয়, সেশন জট, অনার্স পাস হয় না । বন্ধক কিংবা বিক্রি করতে করতে চাষের জমি কমে এসেছে তবুও নিয়মিত বাড়ি থেকে টাকা আসে। পাশের রুমের সিনিয়র ভাই বিসিএস দিয়ে পুলিশের এএসপি পদে নির্বাচিত হয়েছে । হলের সিনিয়র-জুনিয়র সবাই সালাম দেয়, সামনে কিংবা আড়ালে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করে ।

 


এএসপির এত সম্মান, ছেলেটা মনে মনে সংকল্প করে সেও এএসপি হবে । ঘোড়ার আগে গাড়ি কেনার মতোই গোপনে গোপনে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি । পরীক্ষার সার্কুলার হয়, পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতাও ইতিমধ্যে হয়ে গেছে । ফার্স্ট চয়েজ পুলিশ চৌদ্দ গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ পুলিশের চাকরিতে নেই । পুলিশে ঢুকলে গালিগালাজের ট্রেনিং করতে হয়, মানুষ নষ্ট হয়ে যায় ।

 

একমাত্র ছেলের এমন ভবিষ্যৎ মা কিছুতেই মেনে নেবেন না । ছেলের গোঁ সে এএসপি হবে, এবারও সেই সহজ-সরল বাবা এগিয়ে আসেন । একটির পর একটি ধাপ পেরিয়ে চূড়ান্ত ফল বের হয় । পিএসসি টাঙানো নোটিশ বোর্ডে বান্ধবীসহ  আমি নিজের রোল নম্বর খুঁজতে থাকি

 

পুলিশ ক্যাডারেই খোঁজে । নিচের দিক থেকে খুঁজতে খুঁজতে না পেয়ে হতাশা বাড়তে থাকে । তো হতেই পারে না, পরীক্ষা অনেক ভালো দিয়েছে । উপরের দিকে প্রথম রোলটা দেখে নার্ভাস হয়ে যাই, ভুল দেখছি না তো ? বান্ধবীকে দেখতে বলি , নিজেও পকেট থেকে অ্যাডমিট কার্ড বের করি । না, সত্যিই রোল নম্বর মিলে যাচ্ছে ! ছেলেটা প্রথম হয়েছে ! পরের দিন বাড়িতে ফিরে যাই ।  অনেকক্ষণ মায়ের পাশে বসে থাকি । স্বপ্নের চাকরিতে জয়েন করি ।  দিন, মাস, বছর গড়ায় । ধাপে ধাপে  আমার পদ বাড়ে ।

 

সেই আমি এখন পুলিশ বিভাগের উচ্চ পদে । এতগুলো বছর গড়িয়েছে, বদলে গেছে অনেক কিছুই । বাবা গত হয়েছেন, মায়েরও বয়স বেড়েছে, নানা রকম রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে । বদলাননি মা। কাজের চাপে বাসায় ফিরতে দেরি হলে মা ঘুমান না, ফোন করে তাড়া দেন । সকালে অফিসে যাওয়ার সময় মা বলেন, ‘সাবধানে যা, সঙ্গে লোক আছে তো ।

 

হরতাল হলে মা বলেন, ‘এই গোলমালের মধ্যে অফিসে যাওয়ার দরকার কি । আমি হাসি আর  মাকে বোঝাই, গোলমালে পুলিশের দায়িত্ব বাড়ে । টিভি খুললেই ছেলেকে দেখা যায় । মা ফোন করেন, ‘তোর মুখটা এত শুকনা কেন ?’  খাবার টেবিলে মা বলেন, ‘এত কম খাইলি ?’  মায়ের সামনে পড়লেই মা বলেন, দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছিস । তোর কোনো অসুখ-বিসুখ হয় নাই তো ?

 

মাঝে মাঝে নাতি-নাতনিদের ছেলের ছোটবেলার গল্প শোনান । কাছে না থাকলে অসুস্থ শরীর নিয়েও প্রতিদিন ফোন করেন, ছেলের শরীরের খবর নেন । মায়ের অবস্থা দেখে মনে হয়, তার সেই ছোট্ট ছেলেটি এখনও সেইটুকু রয়ে গেছে । পৃথিবীর সবকিছু বদলায়, বদলায় না শুধু সন্তানের প্রতি মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা । এই মমতাময়ী মা আমার মা, আমার গর্ভধারিণী মা, পৃথিবীর সব মায়েরই প্রতিচ্ছবি ।

 

লিখা : Monirul Islam Sir

Additional commissioner of Bangladesh police

The current Chief of Counter Terrorism and Transnational Crime (CTTC).



 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা