চিরকুট

 

 

গল্পঃ চিরকুট

লিখাঃ ইমু

 

 

কিছুক্ষণ আগেই আমার বিয়ে হয়েছে। বাবার বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে আমার প্রথম রাত।  

নতুন মানুষনতুন মুখ।

বিয়ে ঠিক হয়েছে মাত্র ১২ দিন আগে । হুটহাট বিয়েটা হয়ে গেলো । তারা প্রস্তাব দিলো আব্বার পছন্দ হলো বিয়ে হয়ে গেলো । অর্থাৎ আমার বিয়ে হলো এরেঞ্জড ম্যারেজ …… একটু সময় পাই নাই জামাই এর সাথে বিয়ের আগে দুই একটা কথা বলার

আমাকে কিছুক্ষণ আগে আমার ননদ আর ইফতি মানে আমার স্বামীর ভাবী আমার রুমে রেখে গেলো । এত ভারী ভারী গহনা আর শাড়ি পড়ে আমি কাহিল । ভাবতেই আওয়াজ পেলাম ঘরে কেউ ঢুকছে ।

ইফতি ঘরে ঢুকেই প্রথম কথা বলল

-আয় হায় তনু তুমি এখনো শাড়ি গহনা পড়ে আছো? ফ্রেশ হউ নাই কেন?

-জ্বী হবো এখন।

-আচ্ছা শুনো আমাকে আপনে করে বইলো না । আমি আগে ফ্রেশ হতে যাবো নাকি তুমি আগে ফ্রেশ হবা ?

ঘরের সাথে এটাচড বাথরুমনতুন বৌ আমি এমনেই লজ্জা লাগছে আমি কি বা উত্তর দিতাম ?

-আপনি যান ।

-আবার আপনি ?

-সরি একটু সময় লাগবে ।

-হাহাহাহা আচ্ছা । সময় নেওতুমি গহনা খুলতে খুলতে আমি ফ্রেশ হয়ে যাবো ।

-আচ্ছা ।

ইফতি ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে গেলো ।

আমি খুব বোর হচ্ছিলাম

ইফতি ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে বলল

-যাও তনু তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো অনেক সকালে উঠতে হবে ।

আমি টাওয়াল হাতে নিয়ে বাথরুমে গেলাম । কাল আমাদের সকালে উঠতে হবে কারণ ভোর বেলা আমাদের কক্সবাজার এর যাত্রা শুরু হবে .. আমি আর ইফতিই যাবো । বিয়ের পর স্বামীর সাথে একান্তে ঘুরতে যাওয়াকে হানিমুন বলে .. আমি কাল হানিমুনে যাবো । কিন্তু কক্সবাজার কেন ?

এই কক্সবাজারে আমার অনেক স্মৃতিমন খারাপের স্মৃতি .…

খুব বড় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ফ্রেশ হয়ে নিলাম । শাড়ি চুরি গহনা খুলে এখন অনেক শান্তি লাগছে ।

বের হয়ে দেখলাম ইফতি আমাদের ব্যাগ গুছাচ্ছে । আমি ওকে হেল্প করলাম ব্যাগ গুছাতে । ইফতি অনেক হাসিখুশি এই জিনিসটা আমার খুব পছন্দ । হেসে হেসে কথা বলে তাছাড়া চাচ্ছে আমি ওর সাথে একটু ফ্রি হই তাই ব্যাগ গুছানোর সময় সে অনেক হাসির কথা বলে আমাকে স্বাভাবিক করতে চাচ্ছিলো । সব কাজ শেষ হলো পরে ইফতি আমার হাত ধরলো.… ধরে বলল

- তনু আজ তোমার মন খারাপ থাকাটা স্বাভাবিক । তুমি আজ ঘুমাও । আমরা কাল ঘুরতে যাবো । ঘুম ঠিক মত না হলে তোমার খারাপ লাগবে ।

-ঠিকাছে ।

আমরা শুয়ে পড়লাম । একটু লজ্জা লাগছিলোইফতি আমার পেটে হাত রেখে শুয়ে পড়লো । আমি আসলেই খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম । শুয়ে হঠাৎ ইফতি কে জিজ্ঞেস করলাম

-আচ্ছা ইফতি সব রেখে কক্সবাজার কেনো যাচ্ছি আমরা ?

-কারণ সমুদ্র সুন্দর । তুমি যাও নি ?

-গিয়েছিলাম-গিয়েছিলাম ।

-তাহলে এখন যেতে চাইসো না যে ? সমুদ্র তোমার ভালো লাগে না ?

-লাগে কিন্তু ঐখানে একটা ঘটনা ঘটেছিলো তাই আমি ……

-থাক এই গল্প কাল শুনবো । এখন ঘুমানোর চেষ্টা করো ।

ইফতি আমার চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙ্গুল দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ।

কখন ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেই পারলাম না । সকালে উঠে চোখ খুলে দেখি ইফতি গোসল করে রেডি হচ্ছে । আমি তাড়াহুড়ো করে উঠলাম । বলল

-এত তাড়াহুড়া করার কিছু নাই । তুমি আস্তে ধীরে ফ্রেশ হউ । আমাদের বাস আরো . ঘন্টা পর..

-না তারপরও আমার আগে উঠা উচিৎ ছিলো ।

দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে গোসল করে রেডি হয়ে রুম থেকে বের হতেই সবার উৎসুক চোখ আমার ভেজা চুলেভাবীরা দুষ্টামি করে কানের কাছে এসে

জিজ্ঞেস করছে " ঘুম হইসে নাকি সারারাত জেগে ছিলা ?"

আমি বেক্কলের মত তাকিয়ে রইলাম তাদের দিকে । আমরা যে আসলে কি করেছি সারারাত সেটা আমরাই জানি । যাইহোক কোন রকমে হালকা হেসে কথার কোনরকম উত্তর দিয়ে নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম । আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই আমাদের এগিয়ে দিতে আসলো । বাস যথাসময়েই ছাড়লো । সম্পূর্ণ রাস্তা ইফতি আমাকে অনেক গল্প বলে ফ্রি করার চেষ্টা করলো । কথায় কথায় আপনি তুমিতে রূপান্তরিত হলো । এর মধ্যে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম

- ইফতি তোমার কখনো কারো সাথে প্রেম হয়েছে ?

-হুম হয়েছে তো ।

-উনি কই এখন ?

-আমার পাশে বসে আছে । হাহাহাহাহা ।

-আহহহা সিরিয়াসলি ।

-আমি সিরিয়াস । তোমার হয়েছে ?

-হ্যাঁ হয়েছে ।

-সে কই ?

-জানিনা ।

-আচ্ছা থাক যেটা জানোনা সেটা নিয়ে আর কোন আলোচনা হবে না ।

আমরা ব্যাপারে আর কথা বললাম না ।

বাস থেকে নেমে হোটেলে পৌঁছে আমি ফ্রেশ হতে যাবো এমন সময় ইফতি আমার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল ।

-গিফট টা বাসর রাতে দিতে চেয়েছিলাম । কিন্তু আজ এটা দিলে তোমার বেশি পছন্দ হবে তাই আজ দিলাম । তুমি ফ্রেশ হয়ে নেও । আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি ।

ইফতি তরতর করে বের হয়ে গেলো ।

রুম থেকে বের হয়েছে সাথে সাথেই আমি প্যাকেট খুলায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম ।

একটা প্যাকেটে মোড়ানো অনেকগুলো কাগজ । এক এক টা ছোট চিরকুট ।

আমি চিরকুট গুলো হাতে নিচ্ছি আর আমার চোখ বেয়ে পানি ঝরছে ………

বুকে জড়িয়ে কাঁদছি চিরকুট গুলো নিয়ে ।

চিরকুটে আমার চোখের পানি পরে কলমের কালি ছড়িয়ে যাচ্ছে ।

লেখাগুলো গাঢ় হয়ে ভেসে উঠছে "হ্যাঁ ভালোবাসি"

আমি মেঝেতে বসে তখনো বুকে জড়িয়ে কাঁদছি ।


  মাস আগের কথা ।

আমি আব্বু আম্মু আর আমার ছোট ভাই কক্সবাজার বেড়াতে এসেছিলাম । ১২ দিনের জন্য । প্রথম বার এসেছিলাম সেইবার ……

আমি খুব খুশি ছিলাম । সমুদ্র এত সুন্দর আমি জানতাম না ।

হোটেলে উঠে আমরা ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে গেলাম । এক রুমে আমি আর আমার ছোট ভাই আরেক রুমে আব্বু আম্মু।

প্রথমদিন বীচে ঘুরে যখন সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে ফিরলাম তখন দু চোখ ভেঙ্গে আমার ঘুম । রুমে গিয়েই কোন কথা না বলে ঘুম । রাতে কিছু খাই নাই । যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন ঘড়িতে প্রায় টা বাজে ।

আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি সায়েম আমার ছোট ভাই ঘুম । ক্ষুদার্ত আমি কিছুই খুঁজে পেলাম না । সাহস করে উঠলাম । একা একা হোটেলের ক্যান্টিনে গিয়ে দেখলাম ঐটা ২৪ ঘন্টাই খোলা আছে । টুপ করে খেতে বসলাম । রেস্টুরেন্ট টা ছিলো সাগরের একেবারেই কাছে । আমি যেখানে বসে খাচ্ছিলাম সেখান থেকে রাতের সাগর দেখা যাচ্ছিলো । খাওয়ার সময় খেয়াল করলাম সাগর এর পাশ থেকে গানের আওয়াজ আসছে " আমি তারায় তারায় রটিয়ে দিবোতুমি আমার"

একদল ছেলে গান গাইসে । এভাবে সমুদ্রের গর্জন গান আকাশ আর সামনে খাবার্ । অসাধারণ গান গাইছিলো । একের পর এক গানখুব ইচ্ছা করসিলো ওদের সাথে গিয়ে গান গাই অথবা পাশে বসে শুনি । অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিলো না কে বা কয়জন ঐখানে । আমি খাওয়া শেষে বেলকুনির রেলিং দাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ যাই হোক একটু পর খেয়াল করলাম তাদের গান বন্ধ করে তারা চলে যাচ্ছে । অনেক রাত তখন আমি নিচেও নামার সাহস পাচ্ছি না । নতুন জায়গা কিছুই চিনি না । কিন্তু গান বন্ধ করে চলে গেলো আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো ।

রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম ।

সকালে আমার সবার আগেই ঘুম ভাঙ্গলো । আব্বু আম্মু কে ডেকে তুলতে রুম থেকে বের হয়েই দেখলাম দরজায় একটা চিরকুট যাতে লেখা --- " রেলিং এর এত কাছে এসে কি দেখছিলেন ? নাকি গান শুনছিলেন ? কিছুক্ষণের জন্য আমি হঠাৎ আপনাদের হোটেলের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম । লম্বা লম্বা চুলে আভছা আলোয় আপনাকে দারুন লাগছিলো.. কিন্তু এত রাতে লম্বা চুলে ভূত ভাবসিলাম । জানতে পারলাম আপনার নাম নাকি তনু । আমাকে যদি কেউ আপনার নাম রাখতে দিতো আমি আপনার নাম তৃষ্ণা রাখতাম । কেমন যেনো একটা তৃষ্ণা ভাব আছে আপনার মধ্যে । যাই হোক এত কাছে এসেন না বারান্দার হাহাহাহাহাহা ।"

আমি দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে খুঁজে কাউকে পেলাম না । কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারছি না । কি জিজ্ঞেস করবো ? একটু পর আব্বু আম্মু আর সায়েম সহ নাস্তা করতে গেলাম । নাস্তা শেষে আবার বীচে গেলাম । আশ পাশে যেই গান গায় মনে হচ্ছিলো কালকে রাতের ছেলে গুলোর মধ্যে কেউ গাইছে । সারাদিন ঘুরে ফিরে সন্ধ্যায় হোটেলে গিয়ে দূর থেকেই আমি দেখতে পাচ্ছি দরজায় আরেকটা চিরকুট ।আমি দৌড়ে সায়েমের আগে গিয়ে কাগজটা দরজা থেকে নিয়ে লুকিয়ে ফেললাম ।

ঐদিন লেখা ছিলো ----- "দিনের আলোয় দেখলাম আপনাকে । আপনি তো দারুন সুন্দরী । বীচের মানুষ গুলো কিভাবে যেন বারবার আপনার দিকে তাকাচ্ছিলো । খুব রাগ হচ্ছিলো । পরদিন থেকে মুখে একটু কালি মেখে বের হবেন ।"

তারমানে সে আমাকে দেখছে । ফলো করছে । আমি কত গাধা একটা মানুষ আমাকে এভাবে নোটিশ করে অথচ আমি টের পাই নি । কোনরকমে সবাই ঘুমিয়ে পরার পর আমি একটা চিরকুট লিখলাম --- "কে আপনি ? আমাকে দেখেছেন কিন্তু আমি তো দেখলাম না আপনাকে । আজ রাতে গান গাইবেন ? আর আমি আপনাকে কিভাবে পাবো ? জানালে উপকৃত হতাম ।"

লিখে দরজায় লাগিয়ে রাখলাম । তখন ঘড়িতে ১২ টা বাজে । আমি বার উঠে দেখলাম চিরকুট জায়গা মতই আছে । কেউ নেয় নি । মন খারাপ হয়ে গেলো । বারের সময় দেখলাম নতুন চিরকুট । ----"শোনো মেয়ে আমাকে খুঁজে কি হবে । এত রাতে ভুলেও হোটেল থেকে বের হওয়ার চিন্তা করবা না । গান শুনতে চাইলে গতকাল যেখানে বসে শুনেছো আজও ওখানেই থেকো । কিন্তু রেলিংয়ের এত ধারে যেয়ো না । আমি আছি তুমি এসো ।"

আমি আস্তে আস্তে রুমের গেট খুলে বের হয়ে গেলাম । সায়েম বেভোর ঘুম । রেস্টুরেন্টে কফি অর্ডার করে সেই বেলকুনির পাশে গিয়ে বসলাম । ওরা আজ রেস্টুরেন্টের একটু কাছাকাছি বসেছে । গতরাতের চেয়ে আজ গান আরো পরিস্কার শোনা যাচ্ছে । আমি গিয়েই আমার পছন্দের একটা গান পেলাম । " আজ তোমার মন খারাপ নেই" এমন অনেক সুন্দর গান চলল ভোর রাত পর্যন্ত .. ওরা চলে যাচ্ছিলো আমি দূর থেকে অন্ধকারে দেখলাম ওরা / জন । ঐখানে ছেলেটা কি গান করে নাকি ?

আমি রুমে গিয়ে আরো একটা চিরকুট লিখলাম----"এদের মধ্যে আপনি কোনটা? গান কি আপনি গান ? আচ্ছা আপনারা কোন হোটেলে আছেন "?

আমি দরজায় আটকে আসার পর দরজার নিচে তাকিয়ে রইলাম ভাবলাম আজ জেগে থেকে দেখবো দরজার নিচে ছায়া পেলেই হাতে নাতে ধরবো । কিন্তু পাই নাই । সকালে তড়াহুড়ো করে উঠে দেখলাম আমার চিরকুট নাই , নতুন চিরকুট নাই । অস্থির হয়ে এদিক থেকে সেদিক খুজলাম কিন্তু নাই । হয়তো অন্য কেউ খুলে নিয়েছে । হয়ত বাতাসে উড়ে গিয়েছে হয়ত সে পায় নাই । মন খারাপ করে ঘরে ঢুকতেই দেখি দরজার নিচে দিয়ে নতুন চিরকুট ।

" এই মেয়ে টিপের আঠা দিয়ে দরজায় চিরকুট থাকে ? পাগলি ! আমি তোমার চিরকুট সিড়িতে পেয়েছি । যদি হারিয়ে যেতো ? ভালো আঠা দিয়ে লাগাবে । আর শুনো আজ রাতে তুমি ঘুমাবে । এত কম ঘুমালে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে ।"

আমি চিরকুট হাতে নিয়ে হাটছি  ,ভাবছি  ,ঝিমাচ্ছি হাসছি । অদ্ভূত সেই অনুভূতি । এভাবে সবার চোখকে আড়াল করে ছোট ছোট চিরকুটের মধ্যে প্রেম জন্ম নিচ্ছিলো একটু একটু করে ।

বীচে আব্বু আম্মুর সাথে গেলে কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে ভাবতাম এইটাই ছেলে । প্রতি রাতে অপেক্ষায় থাকতাম সবার ঘুমের আর গানের । রেস্টুরেন্টের লোকগুলো প্রতিদিন আমাকে দেখে হাসি দিতো । ওরাও হয়ত বুঝতে পারছিলো ভালোবাসা টা হতে চলেছে । প্রতি রাতে গান শোনা শেষে ওরা চলে যেত আর আমি রুমে এসে চিরকুট লিখে দরজায় লিখে রাখতাম ।

একদিন লিখলাম ---- "আমি তো আপনার নাম জানি না । আপনি অন্তত আমার নাম জানেন । আমি আপনাকে দেখিও নাই নামটাও জানিনা । এটা বেশি অবিচার হয়ে গেলো না ।? "

সকালে এর উওর আসলো ---- " তুমি আমাকে প্রেমিক নামে ডাকতে পারো । জানো এই যুগেও যেই মেয়েগুলো চিঠি লিখতে ভালোবাসে তাদের আমি হালকা পাগলি বলি আর যারা চিঠি পাওয়ার অপেক্ষায় অস্থির থাকে তাকে সম্পূর্ণ পাগলি বলি" …

আমি চিরকুট পেয়ে হাসতে হাসতে কাহিল । চারিদিকে রোমান্স রোমান্স লাগে ।

পরেরদিন চিরকুট লিখলাম --- " প্রিয় প্রেমিক একটা জিনিস খেয়াল করলাম আমি নাহলে অস্থির থাকি সাথে মনে হচ্ছে আপনিও থাকেন আমার চিরকুটের ।"

মধ্যরাতে সেই চিরকুটের উত্তর পেলাম ---- " পাগলি আমি মনে হয় প্রেমে পড়ে যাচ্ছি । আজ তোমাকে দু হাত দূর থেকে দেখেছি । তোমার চুলে ঘ্রান ছিলো । অদ্ভূত ঘ্রাণ মাতাল করা ঘ্রাণ"

আমি চিরকুট টা হাতে নিয়ে বুকে জড়িয়ে সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

যাওয়ার সময় চলে আসছিলোযাওয়ার ঠিক আগের দিন।

আমি ওকে কিভাবে পাবো সেই চিন্তায় পরে গেলাম । চিরকুট লিখলাম রাতে

" প্রেমিক কাল চলে যাবো আমরা ।  আমি তোমাকে কিভাবে পাবো ? তোমার নাম ফোন নাম্বার কিছুই তো জানি না । আমি তোমাকে কই পাবো ?"

সেদিন উওর পাচ্ছিলাম না । ঘড়ির কাটায় তখন .৩০ টা বাজে.. তার প্রতিদিনের উত্তরের পরেই আমি রেস্টুরেন্টে গান শুনতে যেতাম ।

আজ এখনো কোন উত্তর নাই.. ঘড়িতে তখন টা বাজে না পারতে খুব সাহস করে আজ হোটেল থেকে বের হয়ে বীচে গেলাম । যেই / জন গান গাইছিলো তারা আমাকে দেখে বেশি মাত্রায় অবাক । আমি কি জিজ্ঞেস করবো বুঝতে পারসিলাম না । কারণ আমি তো নামও জানিনা । তারপর জিজ্ঞেস করে বসলাম

-এখানে কে আমার দরজায় প্রতিদিন চিরকুট রেখে আসেন ?

প্রত্যেকে একে অপরের চেহারার দিকে তাকিয়ে অস্বীকার করলো । কেউই নাকি এই কাজ করে নি । আমার কান্না আসছিলো ।

ধরনের ইমোশন নিয়ে কেউ মজা করে ?  আমি অনেক অনুরোধ করার পরও তারা অস্বীকার করলো । আমি কান্না করতে করতে হোটেলে চলে আসলাম । কেউ আমাকে একটু ডাক দিলো না চলে আসার সময় ।

আমি শেষ একটা চিরকুট লিখলাম---"আমি সকালে চলে যাচ্ছি । তুমি আমাকে অস্বীকার করলে । শুধুই মজা করলে আমার ইমোশন নিয়ে । কে তুমি নাম কি কিছুই জানি না । কিন্তু তোমার চিরকুটের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম । প্রতি রাতে একটা চিরকুটের জন্য অপেক্ষা করার পিছনে কতটা ভালোবাসা ছিলো বুঝবে না । তোমার জন্য এগুলা শুধু মজা ছিলো হয়ত । আমার জন্য ভালোবাসা ছিলো । হ্যাঁ ভালোবাসি আমি । খুব কষ্ট নিয়ে ফিরতে হবে এখান থেকে ভালো থেকো ।"

সারারাত আমার আর ঘুম হলো না । সকালে দরজা খুলে নতুন একটা চিরকুট পেলাম ।

"তনু নিজের যত্ন রেখো । তোমার কোন অযত্ন হলে কিন্তু মাফ করবো না । কষ্ট পাবে না একদম । কান্না তো করবেই না । তোমাকে মানায় না । তোমার প্রেমিকের এটা শেষ চিরকুট । আর তনু আমিও তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি । ভালো থেকো পাগলি ।"

 আমি সেদিনও ঠিক এভাবেই কেঁদেছিলাম আজ যেভাবে কাঁদছি । ঢাকায় যাওয়ার পর বেশ অনেকদিন মন খারাপ করে ছিলাম । আমার বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করেছি কেউ একজন আমার দরজায় চিরকুট রেখে বলবে

-"পাগলি আমাকে মিস করো ?"

কেউ আর চিরকুট দেয় নি ।

আজ ইফতির দেওয়া এই গিফট আমি কোনদিন আশা করি নাই । এই সব গুলো চিরকুট আমার হাতের লিখা । সব গুলো চিরকুটের সাথে আরো একটা চিরকুট যেটায় লিখা----

-তনু তুমি প্রথম যেদিন রেস্টুরেন্টে বসে গান শুনছিলে সেদিন তুমি গানে আর সমুদ্রের আওয়াজে এতই ব্যস্ত ছিলে আমি তোমার পাশের টেবিলে বসা তুমি খেয়াল করো নি  ,  জায়গা বদলে গেলে আমার ঘুম হতো না । তাই আমি রাত জেগে তোমার মত ওদের গান শুনতে যেতাম । কিন্তু প্রতিদিন তোমাকে দেখতে দেখতে তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম । তোমার চোখের , তোমার চুলের, তোমার বীচে গিয়ে সাগরের ঢেউ এর সাথে খেলার সব কিছুর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম । আমিও সেইখানে আমার পরিবারের সাথে এসেছিলাম একই হোটেলে ছিলাম কিন্তু তুমি কখনো খেয়াল করো নি । তারা তোমার কথা জানতো । তুমি যাওয়ার দিন যেভাবে কাঁদছিলে একবার ভেবেছিলাম সামনে এসে তোমাকে জড়িয়ে ধরি । তোমরা ঢাকায় যাওয়ার পর খোঁজ নিয়ে জানলাম তোমার পরীক্ষা । পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিলাম । আর ১২ দিনের মাথায় বিয়ে । যেই ১২ দিনের মাথায় তুমি আমাকে বলেছিলে আমাকে ভালোবাসো ।  ১২ দিনে কি স্বামী হিসেবে আমাকে ভালোবাসতে পেরেছো ?  হয়ত পারো নি ।  এই কক্সবাজারে আমি তোমাকে পেয়েছিলাম । তাই এখানেই তোমাকে পেতে চেয়েছি সেজন্য কাল তোমার প্রতি অধিকার থাকা স্বত্তেও তোমাকে একটু জড়িয়ে ঘুমানো ছাড়া আর কিছু করতে চাই নি ।  আমি চেয়েছি তুমি আমাকে ভালোবেসে স্পর্শ করো । তোমার প্রথম স্পর্শে থাকুক অনেকদিন পর হারানো মানুষকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দ । আমাকে জড়িয়ে তুমি সেভাবেই কেঁদে ফেলো যেভাবে তুমি এখন চিরকুট পড়ে কাঁদছো । আমি বলেছিলাম টা তোমার প্রেমিকের দেওয়া শেষ চিরকুট আর এটা তোমার স্বামীর দেওয়া প্রথম চিরকুট । আজ যদি আমাকে কেউ তোমার নাম রাখতে দিতো আমি তোমার নাম "বৌ" রাখতাম । বৌ আমি সেই রেস্টুরেন্টে তোমার অপেক্ষা করছি । তুমি জলদি এসো ।"

আমি কোনরকমে চোখ মুছে খালি পায়ে দৌড়ে গেলাম সেই রেস্টুরেন্টে ..আমাদের হোটেল থেকে মাত্র মিনিটের রাস্তাআমাকে হয়ত রাস্তার সবাই পাগল বলছিলো এভাবে দৌড়ানোর জন্য । খেয়াল করি নাই । রেস্টুরেন্টে উঠে দেখলাম সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্টে মোম দিয়ে সাজানো । হালকা গান আর আমার স্বামী ইফতি দাড়িয়ে আছে বেলকুনির রেলিং ধরে । আমি যেভাবে দাড়িয়ে থাকতাম ।

আমি আস্তে আস্তে হেটে ওর পাশে যাওয়ার সাথেই বলল

"তোমার সেই ঘ্রাণ তনু পাগল করা ঘ্রাণ.."

আমি জাপটে ওকে জড়িয়ে ধরলাম পিছন থেকে । ইফতি বলল

-আজ তোমার ঘ্রাণ নিতে আড়ালে থাকতে হবে না ।  তুমি আমার বৌ ।

আমি ইফতিকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদছিলাম । এই মানুষ টাকে না জেনেই ভালোবেসেছিলাম হারিয়েও ফেলেছিলাম আজ আবার পেয়েছি । আজীবনের জন্য । আমি কাঁদছিলাম আর বলছিলাম---

-ইফতি তোমাকে ভালোবাসি । অনেক বেশি ভালোবাসি । তুমি কেন চলে গিয়েছিলে ? আমি জানতাম না তুমি কে ?  আমি বিয়ের আগে পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি তোমার কেন আসো নি ? এভাবে কেন কষ্ট দিলা ?

-কষ্ট দিয়েছি সেজন্য সরি বৌ কিন্তু পরে এভাবে যে তুমি আমাকে ভালোবাসবে সেটা ভেবেই আড়াল ছিলাম । তনু আমিও তোমাকে ভালোবাসি । অনেক বেশি । গান কিন্তু আমিও গাইতে পারি । শুনবা ?

-এত দিন পর তোমাকে পেয়েছি । তোমার বুকেই থাকবো এখন । গান টান কিছু লাগবে না ।

-হাহাহাহা ..

সেদিন নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী বিবাহিত নারী মনে হচ্ছিলো ।  হয়তো আমার চেয়ে রোমান্টিক হানিমুন বোধহয় আর কেউ করে নি ।


 

বেচেঁ থাকুক ভালোবাসা সব গল্পের শেষের পাতায়

(সমাপ্ত)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা