গল্পঃ "জ্বীন প্রতিবেশী" --- পর্বঃ ০৮

গল্পঃ "জ্বীন প্রতিবেশী"

পর্বঃ ০৮


 অনিলার ঘুম ভেংগে যায়। সে বুঝতে পারে এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো। আহমাদ কে স্বপ্নে তার এতো কাছাকাছি দেখে মনটাই ভালো হয়ে যায়। 
অনিলা বিছানা থেকে উঠে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কেনো যেনো নিজেকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে!

লাবনি ইসলাম আলমারি থেকে একটা পুরনো ডায়েরি বের করেন। এক সময় খুব ডায়েরি লিখতেন তিনি। এখন আর আগের মতো লেখাই হয়না। তিনি ডায়েরি টার মাঝ বরারবর খুললেন। 
সেখানে তার নিজ হাতে গোটা গোটা অক্ষরের লেখা গুলির উপরে চোখ বুলান। 
"
আজ সাত বছর পূর্ণ হয়েছে আমাদের বিয়ের। আল্লাহ্' অশেষ রহমতে আমাদের ভালোবাসার কোনো কমতি নেই এই সংসারে। তবে এতো ভালো বাসার মাঝে একটি সন্তানের জন্যে হাহাকার লাগে মাঝে মাঝে। আজ সাত বছর ধরে আমি একটি সন্তানের আশায় আছি।
লাবনি ইসলাম ডায়েরির পরের পাতা উল্টান। তার হাত দুটো মৃদু মৃদু কাঁপছে
আমি অাজ আমার সন্তান কে আমার কোলে পেয়েছি। আল্লাহ আমার সুখের ঘর টাকে আলোয় পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। কিন্তু এই সন্তান কে পেতে আমার নয় মাস কষ্ট করতে হয়নি। গত কাল রাত তিনটায় মা আর বাবা এসে আমার কোলে এই মিস্টি সোনা কে দিয়ে গেছেন। 
বাবুকে আমার কোলে নেয়ার সময় আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম " বাবা, এতো সুন্দর এই বাচ্চাটা কার?কার বাচ্চা আমাকে দিচ্ছেন?" বাবা বলল,মা, তোকে একবার আমার এক প্রিয় বন্ধুর কথা বলেছিলাম না? যে তোর জন্য অনেক মিস্টি আর ফল দিয়ে যেতো, এই কন্যা শিশুটা তার নাতনি।
"
বাবার এই কথা শুনে আমার বুক ধক্ করে উঠলো।কারন আমি বুঝতে পেরেছিলাম, বাবা তার যেই বন্ধুর কথা বলছেন, সে কোনো মানুষ নয়। আমি যে সেদিন মায়ের সাথে বলা বাবার জ্বীনের সাক্ষাত পাওয়ার ঘটানা টা শুনে ফেলেছিলাম সেটা কিন্তু বাবা মাকে কখনোই জানতে দেইনি। আমি মনে মনে ভাবলাম একজন জ্বীনের নাতনীর তো মানুষ হওয়ার কথা নয়! অামি ভয় পেয়ে বাচ্চাটাকে আবার বাবার কোলে দিয়ে দিলাম। 
বাবা বল্লেন " মা বাচ্চাটাকে তোর কাছে দিলাম। ওর মা বাবা এখন থেকেও নেই। তোর কাছে আমার অনুরোধ, তুই এই চল্লিশ দিনের শিশুর আঠারো বছর হওয়া পর্যন্ত তুই একে মাতৃস্নেহে বড় করে তুলবি।" বাবা এই কথা বলে বাচ্চাটাকে আবার আমার কোলে দিলেন। এবার আমি তাকে কোলে নিয়ে রাখলাম। বাবা একটা ছোট পুটলি অামার হাতে দিলেন।অামি পুটলিটার ভেতরে উকি দিলাম। 



দেখলাম ভেতরে অনেক গুলি তাবিজ। বাবা আমাকে ফিসফিসিয়ে বললেন প্রতি আরবী মাসের প্রথম চাঁদে এই তাবিজ গুলি একটা একটা করে বাচ্চাটার বাহুতে বেধে দিতে। যেদিন তার বয়স আঠারো পূর্ণ হবে সেদিন থেকে আর লাগবেনা। তার পর থেকে এই মেয়েটা যেখানে চলে যেতে চাবে আমি যেন বাধা না দেই। এই বলে বাবা আমার হাতে একটা পুরনো কাগজ দিলেন।ওখানে হিবিজিবি করে কি কি লিখা যেনো। তার পরেই বাবা মা বের হওয়ে গেলেন বাসা থেকে। আমাকে আর কিছু বলারো সুযোগ দেন নি তারা।
আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলাম। এতো সুন্দর একটা বাচ্চা! কিযে মায়া মায়া মুখ। জ্বীন জাতির বাচ্চারা বুঝি এতো বেশি অাদুরে অাদুরে হয়! অামি তাকিয়ে দেখি তার ছোট্ট বাম বাহুতে একটা তাবিজ বাধা।
আমি বাচ্চাটাকে অামার বুকের সাথে শক্ত করে আটকে ধরি। অার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি নাম না জানা এই রহস্যময় শিশুটার প্রেমে পরে যাই!

লাবনি ইসলাম এবার ডায়েরি টাকে বন্ধ করলেন। তার মনে আছে এখনো, যেদিন তার বাবা মা বাচ্চাটাকে তার কোলে দিয়ে গেলেন, সেদিন তার স্বামী বাসায় ছিলেন না।অফিসেও কাজে বাহিরে ছিলেন। তিনি পরদিন বাসায় এসে তার স্ত্রীর কোলে এই বাচ্চাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বাচ্চার বাবা মায়ের ব্যাপারে, কিভাবে পেলো তাকে এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলেন লাবনিকে।
কিন্তু লাবনি ইসলাম তার একটি কথারো জবাব দিলেন না। তিনি শুধু এতো টুকুই বললেন, যদি সত্যিই অামাকে কখনো ভালোবেসে থাকো তাহলে এই বাচ্চাটার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করনা। এই কথা শোনার পর আশরাফ হোসেন অার কখনো কিছু জিজ্ঞেস করেননি। কিন্তু এর ঠিক চার মাস পর তিনি বিদেশ চলে যান। এর পর লাবনি ইসলাম বাচ্চাটাকে নিয়ে সবার নজর এড়িয়ে অন্য শহরে চলে আসেন। তার পর থেকেই শুরু হয় দুই মা মেয়ের সংসার। 

লাবনি ইসলাম ডায়েরি টাকে রেখে দিয়ে অনিলার রুমের দিকে যান। তাকে অনেক কিছু বলার আছে। এখনই সময়। পরে নয়তো অনেক দেরি হওয়ে যাবে। তিনি রুমে ঢুকে দেখেন অনিলা আয়নার সামনে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

--"
কিরে,নিজেকে এতো কি দেখছিস?" 
লাবনি ইসলাম মেয়ের বিছানায় যেয়ে বসেন।
--"
মা, দেখোতো একটু, আমি আগের চেয়েও আরো সুন্দর হয়ে গিয়েছিনা?" 
অনিলা মায়ের দিকে অবাক ভঙ্গি তে তাকায়। লাবনি ইসলাম মেয়ের দিকে ভালো করে তাকালেন। তিনি দেখলেন, অনিলা কে আগের চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী লাগছে! চোখ গুলিও যেনো অারো ডাগর ডাগর হয়েছে।খানিকটা উচ্চতাও বেড়ে গেছে অনিলার।
লাবনি ইসলাম অবাক হওয়ার ভান করে বললেন,
---"
আরেহ তাইতো, আমার মেয়েকে তো অনেক সুন্দর লাগছে।কিরে, প্রেমে টেমে পরলি নাকি কারো? মেয়েরা তো সব চেয়ে বেশি সুন্দর প্রেমে পরলেই হয়।
একথা বলে লাবনি ইসলাম জোরে হেসে উঠলেন।
অনিলা মায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। তার মা তার সাথে কখনো এতো ফ্রি হওয়ে কথা বলেনি। কি যে হলো মায়ের! অনিলা ভাবতে লাগলো। কিন্তু অাসলেই কি মেয়েরা প্রেমে পড়লে এতো সুন্দর হয়ে যায়? তাহলে কি সেও প্রেমে পড়লো কারো?
অনিলা লজ্জা পেতে থাকে। সে জানে সে কার প্রেমে পড়তে পারে! অনিলা মায়ের সামনে থেকে সরে যায়।মাকে কোনো ভাবেই মনের অবস্থা বোঝাতে চায়না সে!
লাবনি ইসলাম মেয়ের বিছানায় গম্ভির মুখে বসে আছেন।অনিলার পরিবর্তন গুলি খুব পরিস্কার ভাবে দেখা দিচ্ছে।সময় খুব দ্রুতই ঘনিয়ে আসছে। অনিলার সাথে কথা বলতে হবে। তিনি মনে মনে ভেবে নিলেন, কিভাবে অনিলার সাথে আলাপ শুরু করা যায়।

আফসানা আর আহমাদ এক সাথে বসে আছে। দুজন কেই খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। তাদের রশিদ চাচা কয়েক দিনের জন্য কথায় যেন গেছেন। কিন্তু অাহমাদের দাদাজান আর আব্বুজান বলেছিলেন, রাশিদ বেগ যেনো তাদেরকে এখানে রেখে কথাও না যায় কিন্তু তিনি এই কথা অমান্য করলেন কেন আহমাদ আর আফসানার বুঝে আসছেনা।
--"
ভাইজান, আমাদের এখানে এভাবে রেখে চাচাজান কোথায় গেলেন? উনি কি ঠিক করলেন ব্যাপারটা?"
--"
অবশ্যই ঠিক করেন নি। তাকে তো দাদাজান আর আব্বুজান আমাদের দেখা শোনার দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। এখন যদি আমরা দু জন কোনো সমস্যায় পরে যাই পরে তিনি কি জবাব দিবেন?"
অাহমাদের কন্ঠে স্পষ্ট রাগ ঝরে পরছে। তার চোখ লাল হয়ে আসছে। 
--"
তাইতো! দাদাজান রাশিদ চাচাজানের অতীতের সব দোষ ক্ষমা করে তাকে অামাদের পরিবারের সাথে রাখলেন।অার উনি কিনা তাদের অাদেশ অমান্য করছেন।"
আফসানা ভাইয়ের সাথে সুর মেলালো। 
রাশিদ বেগ অতীতে তাদের জ্বীন সমাজে সালমান বেগদের বিরোধীদের সাথে হাত মিলিয়ে তাদের ক্ষতি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তি তে তাদের কাছে খবর পৌছানোর পর সে খুব করে ক্ষমা চায় পুরো জ্বীন সমাজের সামনে। সালমান বেগের দয়া হয়। তিনি তার বাবা সোলায়মান বেগের সাথে পরামর্শ করে রাশিদ বেগ কে ক্ষমা করে তাদের সাথে রেখে দেন।
অাহমাদ ভাবে তার চাচাজানের এই গায়েব হওয়ার খবর সে তাদের আব্বুজানের কাছে কোনো ভাবে পৌছে দিবে।



চলবে..........

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা