গল্পঃ "জ্বীন প্রতিবেশী" --- পর্বঃ ১২

গল্পঃ "জ্বীন প্রতিবেশী" 

পর্বঃ ১২ 


#
খাবরি অাসাদ অাফসানার পাশে এসে দাঁড়ায়।আফসানা মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলো। আসাদের উপস্হিতি টের পেয়ে সে মুখ তুলে তাকায়।

--"
ভাইজানের কোনো খবর পেয়েছো?"
--"
জ্বি, অাপনার জন্য সুখবর অাছে। ছোট হুজুর কে খুঁজে পেয়েছি। উনি এখন মুক্ত। ইনশাআল্লাহ, আগামিকাল ভোরের মধ্যে তিনি এখানে পৌছে যাবেন।"

খাবরি আসাদের কথা শুনে আফসানার মুখ খুশিতে জ্বলে উঠে! কিন্তু সে ভাবে খাবরি আসাদ এই খবর পেলো কি ভাবে?
--"
তুমি কিভাবে নিশ্চিত হলে যে ভাইজান রাশিদ বেগের কয়েদ থেকে মুক্তি পেয়েছে। যাদের কে পাঠিয়েছিলে তারা কি করে এতো জলদি খুজে পেলো?"
অাফসানা এখনো নিশ্চিত হতে পারছেনা।
--"
আপনার অনুমতি পেয়ে আমি যাদের পাঠিয়েছিলাম তারা তিনজন খুব শক্তিশালী এবং দ্রুতগামী জ্বীনসেবক। বাতাসের সাথে মিশে তারা চলাচল করতে পারে। তাদের একজন আমাকে এই খবর দিয়ে গেছে।"
--"
ওহ। আলহামদুলিল্লাহ। ভাইজান তাহলে আসছেন। কিন্তু রাশিদ বেগ কে কি পাকড়াও করতে পেরেছো?"
অাফসানা উৎক্ন্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করে আসাদ কে।
--"
জ্বি না। সে আশেপাশে ছিলোনা। কিন্তু আমি দুজন জ্বীন সেবক কে সেখানে পাহাড়ায় থাকতে বলেছি। যেন রাশিদ বেগের উপস্হিতি টের পেলেই তারা তাকে ধরে প্রাসাদে নিয়ে যায়।
খাবরি আসাদের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে আফসানা। আসাদ কে মনে মনে ধন্যবাদ জানায়।
#
আগামী কাল রাতের মধ্যেই চাঁদ উঠে যাবে। লাবনি ইসলাম এই কয়দিন অফিসে যাচ্ছেন না। সারাদিন শুধু কাঁদছেন। কারণ তার মেয়ে খুব কষ্টে আছে এখন। আর চাঁদ উঠার পর পরই অনিলা চিরদিনের মতো তাকে ছেড়ে চলে যাবে।

লাবনি ইসলাম মেয়ের কাছে যেয়ে বসেন। অনিলা এখন ঘুমাচ্ছে। কয়দিনে খুব সুন্দরী হয়ে গেছে সে। তিনি মেয়ের পায়ের দিকে তাকান। অনিলার দুই পা লম্বা হতে হতে বিছানার শেষ সীমানা পর্যন্ত পৌছে গেছে।
লাবনি ইসলামের মনে আছে তিনি যখন অনিলার জন্য এই নতুন খাট বানিয়ে আনেন, তখন অনিলা রাগ করেছিলো, কারণ খাট টার দৈর্ঘ্য অনেক বেশি ছিলো বলে। তার মেয়ের নাকি এতো বিশাল বিছানায় শুতে ভালো লাগেনা।
লাবনি ইসলাম সেই দিনের কথা ভেবে হাসি দিয়ে চোখের পানি মুছেন। তিনি অনিলার হাত ধরেন। ভয়ানক শীতল হয়ে আছে দুই হাত। আর তুলার মতো নরম। লাবনি ইসলামের জায়গায় অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে মারাত্মক ভয় পেতো। কিন্ত তিনি পাননি। সেই কাগজ টায় লেখা আছে, অনিলার শরিরে এই সময় কি কি পরিবর্তন ঘটবে, লাবনি ইসলাম পড়েছেন সব।

অনিলা ধীরে ধীরে চোখ মেলে। ভীষণ যন্ত্রণায় তার চোখ দুটি ভারী হয়ে আছে। সে তার মায়ের দিকে তাকায়। মা হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু মায়ের চোখ ফুলে আছে। মা কি কেঁদেছে নাকি? অনিলা নিজেকে জিজ্ঞেস করে।

লাবনি ইসলাম মেয়ের দু চোখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। গায়ে শিহরণ জাগানো সবুজ দুটি চোখ অনিলার। এতো দ্রুত তার চোখের রং পালটে যাবে লাবনি ইসলাম ভাবতে পারেন নি। তিনি মেয়ের চোখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলেন!
-- "
কি দেখছো মা? আমাকে খুব দূর্বল দেখাচ্ছে না?"
--"
নাহ। তোকে খুব সুন্দর লাগছে।"
লাবনি ইসলাম মেয়েকে হেসে জবাব দেন।
--"
আচ্ছা মা, কয়দিন সূর্য ডোবার সাথে সাথে আমার এমন লাগে কেনো? আজকে ডাক্তার এর কাছে নিয়ে চলো আমাকে।
অনিলার কথা শুনে লাবনি ইসলামের বুক হাহাকার করে উঠে। তিনি মনে মনে ভাবেন, তার যেই কারণে এতো যন্ত্রণা হচ্ছে, এটা কমানোর জন্য কোনো ডাক্তার বা ঔষধ নেই।
--"
তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।
আজ আর কোনো লুকোচুরি নয়। অাজ এখনই লাবনি ইসলাম সব খুলে বলবেন অনিলা কে। সে কে, কী তার অস্তিত্ব, সব।
--"
মা, আগে কিছু খেতে দাও। খুব ক্ষিধে পেয়েছে। পরে তোমার সব কথা শুনবো। "
মেয়ের কথা শুনে লাবনি ইসলামের খুব মায়া লাগে। আর একদিন আছে মেয়েটা তার কাছে।
আজ তাকে তিনি নিজ হাতে তুলে খাওয়াবেন যা খেতে চায় সে। 
--"
কি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে তোর মা? ঝাল কিছু বানিয়ে আনবো?"
ঝাল খাবারের কথা শুনে অনিলা কেমন লাফ দিয়ে উঠে।
--"
না না মা, ঝাল কিছু দিও না। খুব মিষ্টি কিছু দাও। সেমাই বা জর্দা টাইপের।"
লাবনি ইসলাম জানতেন, জ্বীন রা মিষ্টি জাতীয় খাবার খুব পছন্দ করে। আজ সেটা নিজের চোখেই দেখলেন৷ তিনি অনিলার জন্য জর্দা বানাতে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন। অনিলার খাওয়া শেষ হলেই তিনি আর দেরি করবেন না তাকে সব জানাতে।

অনিলা ভাবতে থাকে, আসলে তার আফসানাদের বাসায় খাওয়া সেই মিষ্টি গুলি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু মা কে তো এটা বলা যাবে না। কারণ মা ওদের কথা কিছুই জানেনা।

অনিলা আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করে। সারা শরীরে এখনও খুব ব্যাথা তার। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায় সে।
ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় অনিলা তার ড্রেসিং টেবিলের সামনে থমকে দাঁড়ায়। নিজেকে আয়নায় দেখে খুব জোরে চিৎকার দেয় লাবনি ইসলাম চিৎকার শুনে দৌড়ে অাসেন।

--"
কি হয়েছেরে।চিৎকার দিলি কেনো।"
অনিলার উচ্চতার কারনে লাবনি ইসলাম কে ঘাড় উচিয়ে কথা বলতে হচ্ছে তার সাথে। লম্বায় ছয় ফুট ছাড়িয়ে গেছে অনিলা। তার পড়নের পোষাক গুলি খুবই ছোট হয়ে গেছে!
--"
মা, আমার কি হয়েছে? আমি দেখতে এমন হয়ে গেছি কেনো?"
অনিলার কথা শুনে মনে হচ্ছে সে এখনি কেঁদে দিবে।
--"
আরেহ কিছু হয়নি। তুই ফ্রেস হয়ে আয়। আমি খাবার নিয়ে আসছি"

লাবনি ইসলাম ইচ্ছা করেই মেয়ের সামনে থেকে সরে আসলেন। আজ আর কিছু লুকাবেন না তিনি। কোনো বাহানাও দেখাবেন না অনিলা কে। অনিলা নিজেই নিজের অস্বাভাবিকতা গুলোকে বুঝার চেষ্টা করুক। তাহলে লাবনি ইসলামের জন্যও অনেক সহজ হয়ে যাবে অনিলাকে সব কিছু বুঝানো।

অনিলা ভালো করে আয়নায় নিজেকে দেখতে থাকে। যদিও আয়নাটাতে নিজেকে দেখতে তার কিছুটা ঝুকে নিতে হচ্ছে। নিজের গালে হাত দেয় সে। কেমন নরম আর ঠান্ডা হয়ে আছে তার মুখ। অনিলা এবার নিজের চোখাচোখি হয় আয়নায়। সে দেখে তার চোখ কেমন সবুজ হয়ে আছে। সে তার হাত দিয়ে দুই চোখ স্পর্শ করে।অনিলা এবার খুবই চমকে যায়। তার চোখ দুটো খুব শীতল হয়ে আছে।কিন্তু অনিলার মনে হচ্ছে তার চোখের মতো আর কার যেনো চোখ সে দেখেছিলো একবার। কিন্তু সে মনে রতে পারেনা। অনিলা নিজের ডান হাত কে বা হাত দিয়ে ছুয়ে দেয়। সাথে সাথেই তার মনে পরে যায়, ঠিক এমনি স্পর্শ সে আফসানার কাছে পেয়েছিলো একদিন!! অনিলা খুব ভাবনায় পরে যায়।

লাবনি ইসলাম চুলায় জর্দা বসিয়ে নিজের ঘরে যান। আলমারি খুলে তার পুরোনো ডায়েরি টা বের করেন। আর সাথে সেই রেশমি কাপরের পুটলিটা। এটা তিনি কিছুক্ষন পর অনিলার হাতে দিবেন। এই ডায়েরিতে সবকিছু লিখে রেখেছেন তিনি। লাবনি ইসলাম তার ফোনটা হাতে নিয়ে "অনিলার বাবা" কে ডায়াল করেন।

#
অাহমেদের অার তর সইছেনা অনিলার কাছে জলদি পৌছানোর জন্য সে জেনে গেছে নতুন মাসের চাঁদ এখনো উঠেনি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায় সে। জলদি পৌছাতে পারলে ভালো হতো। আহমাদ মনে মনে ভাবে।
তার আরও প্রায় একশো বছর পার না হওয়া অবধি সে খুব দ্রুত স্থান ত্যাগ করার বিশেষ ক্ষমতা লাভ করতে পারবেনা।
অাহমাদ তার বোন অাফসানার কাছে শুনেছিলো তাদের অঞ্চলে জ্বীনদের হাতে বানানে মিষ্টি গুলো অনিলার খুব ভালো লেগেছে। অাহমাদ তাদের অঞ্চলের কাছাকাছি এসে তার রূপ পরিবর্তন করে অনিলার জন্য কিছু মিষ্টি কিনে নেয়।

#
লাবনি ইসলাম এক বাটি মিষ্টি জর্দা নিয়ে অনিলার রুমে আসেন। অনিলা এখনো আয়নাতে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। লাবনি ইসলাম হাতের বাটিটা টেবিলের উপর রাখেন।

--"
আর কত নিজেকে দেখবি মা? আয়,জর্দা করেছি তোর জন্য, খেয়ে নে।"
লাবনি ইসলাম হাসি দিয়ে মেয়েকে কাছে ডাকেন।
--"
যাই বলো মা, আমার কিন্তু নিজের এই পরিবর্তন খুব ভালো লাগছে।
অনিলা আয়নায় তাকিয়ে নিজে নিজেই হাসতে থাকে।জর্দার বাটিটা টেবিল থেকে নিয়ে লাবনি ইসলামের হাতে দেয় সে। 
--"
আজকে তোমার হাতে খেতে ইচ্ছা করছে মা। খাইয়ে দাও প্লিজ। লাবনি ইসলাম হাসি মুখে মেয়ে মুখে খাবার তুলে দেন। তার খুব কান্না পাচ্ছে।কিন্তু তিনি নিজেকে শক্ত রাখছেন। অনিলার সামনে কিছুতেই কাঁদবেন না তিনি, যত কষ্টই হোক না কেন

অনিলাকে খাওয়ানো প্রায় শেষ। এখনি সময় তার হাতে ডায়েরি টা দেয়ার। লাবনি ইসলাম তার ঘরে যান ডায়েরি টা নিয়ে আসতে।

#
আফসানা একটা চুড়ি হাতে নিয়ে বসে আছে। চুড়িটার উপর অনেক সূক্ষ্ণ কারুকার্য করা। প্রতিটা কারুকার্যের মাঝে মাঝে খুব মূল্যবান পাথর বসানো। চোখ ধাঁধানো আলো বের হচ্ছে গয়নাটা থেকে। 
সোলায়মান বেগ যখন আহমাদ আর আফসানাকে এখানে পাঠান তখন এই একজোড়া চুড়ি তাদের সাথে পাঠান তার নাতনি বিলকিসের জন্য। তিনি খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেনন, বিলকিস যখন তাদের প্রাসাদে পৌছাবে তখন যেনো এই চুরিজোড়া তার হাতে পরা থাকে।
অাফসানা খুব ভয়ে ভয়ে চুড়িটার দিকে তাকিয়ে অাছে।কারন তার হাতে শুধু একটা চুড়ি। আরেকটা সে খুজে পাচ্ছেনা। কিন্তু আফসানা বুঝে ফেলেছে এই চুড়ির আরেকটা জোড়া কথায় আছে। রাশিদ বেগের নাম মাথায় আসতেই আফসানার মেজাজ বিগড়ে গেলো। যে ভাবেই হোক, প্রাসাদে পৌছানোর আগে তাকে খুঁজে বের করতেই হবে!

#
অনিলা মায়ের হাত থেকে ডায়েরি টা নিয়ে তার মাঝ বরারবর খুলে। লাবনি ইসলাম মেয়ের পাশে দাড়িয়ে আছেন। তার বুক ধক্ ধক্ করছে। তিনি বুঝতে পারছেন না, অনিলা সব কিছু জানার পর কী করবে!!


চলবে.......... 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা