গল্পঃ "জ্বীন প্রতিবেশী" --- পর্বঃ ০৩

গল্পঃ "জ্বীন প্রতিবেশী"

পর্বঃ ০৩ 


অনিলা নাস্তা খেয়ে দেখে তার টেবিলের উপর কিছু বই রাখা।সে বুঝতে পারে দুদিন আগে মা অফিস থেকে আসার সময় কিনে এনেছেন।জ্বরের কারনে অনিলা বইগুলি দেখেনি।মনে মনে মা কে ধন্যবাদ দেয় সে।
একটা বইয়ের বদলে পাচঁ টা বই। খারাপ কি!অনিলা খুশি খুশি মনে বই গুলি নিয়ে বসে।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসে।লাবনি ইসলাম এখনো বাসায় ফেরেন নি।অনিলা বই বন্ধ করে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায়।আকাশ টা খুব সুন্দর লাগছে।মনে হচ্ছে কেউ যেন রং ছিটিয়ে দিয়েছে পুরো আকাশ জুড়ে।অনিলার ছাদে যেতে মন চাচ্ছে।অনিলা ভাবে,মা আসার আগে একবার ছাদে ঘুরে আসলে মন্দ হয়না।অনিলা চুলে হাল্কা করে চিরুনী বুলিয়ে ছাদে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়।
অনিলাদের ছাদটা খুব সুন্দর।অনেক ধরনের ফুলের গাছ আছে।দুটো দোলনাও আছে পাশাপাশি। বাড়িওয়ালার রুচি আছে ভালো ।কিন্তু বাড়ির মালিক এখানে থাকেনা না কেনো অনিলার বুঝে আসেনা।নিজের এতো সুন্দর বাড়ি রেখে কেউ যে কিভাবে অন্য জায়গায় থাকে!অনিলা এসব ভাবতে ভাবতে ছাদের দুটো দোলনার কাছে যেয়ে দাড়ায়।ছাদে আসার সময় ভেবেছিল আফসানা কে নিয়ে আসবে। কিন্তু ওদের দরজা আজকে বন্ধ ছিল। তাই অনিলা একাই ছাদে আসে। অনিলা দোলনার চেইন ধরে বসতে নেয়।হঠাৎ তার নাকে সেই সুঘ্রানটা আসে,যেটা সে আফসানাদের ঘরে পেয়েছিল আবার তার সপ্নের মাঝে পেয়েছে সে দুদিন!
যদিও অতটা গুরুত্ব দেয়নি অনিলা।কিন্তু এখন এই ঘ্রান কোথা থেকে আসছে। অনিলা ছাদের বাম সাইডে দেখে,কেউ নেই সেখানে,ডান দিকে দেখে অনিলা সেখানেও কাওকে দেখতে পায়না সে।অনিলা আর কিছু না ভেবে দোলনায় বসে পরে।দোলনায় দোল খেতে খেতে চোখ বন্ধ করে সুঘ্রান টা টেনে নেয় অনিলা।আর গুন গুনিয়ে গান গাইতে থাকে।কিছুক্ষন পরে একটা সুর কানে আসে অনিলার।অনিলা দোলনায় দোলা বন্ধ করেদিয়ে কান খাড়া করে শুনে।তার বুক কেঁপে উঠে! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অনিলা বুঝে যায় এই সুর তার সপ্নে শোনা সেই সুর! খুব কাছে থেকেই আসছে সেটা। অনিলা তার পেছনের দিকটায় ফুল গাছ গুলির দিকে তাকায়।অনিলা যা দেখে সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা সে।অনিলার মুখ হা হয়ে যায়!!!
খুবই লম্বা,চওড়া কাধ,বাবড়ি চুলের একজন সাদা পাঞ্জাবি,পায়জামা পরা মানুষ উল্টো দিকে ঘুরে দাড়ানো।মুখ দেখা যাচ্ছেনা তার।সুরটা তার কাছ থেকেই আসছে।
অনিলা একবার ভাবে সে দৌড়ে পালাবে ছাদ থেকে।কোন পুরুষেরর সামনে কখনোই পড়তে চায়না সে।হতে পারে এটা ছোটবেলা থেকে গার্লস্ স্কুল, কলেজে পড়ার কারনে হয়েছে।অনিলার দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময় দোলনার চেইনের শব্দ হয়।অনিলা থমকে দাঁড়ায়।আর সামনের পুরুষ টি শব্দ পেয়ে পেছনের দিকে ফিরে তাকায়!
অনিলার মনে হয় তার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবে।সে একশো পার্সেন্ট শিওর এতো সুন্দর চেহারা সাধারন কোন মানুষের হতে পারেনা! বড় বড় মায়াবী চোখ,সুরু নাক,হাল্কা চাপ দাড়ি,বাবড়ি চুল,চরম নুরানি চেহারা!অনিলার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দেয় ছেলেটা।তার হাতে একটা বাঁশি!
অনিলা মাথা ঘুরে পরে যেতে নেয়।কিন্তু পরে যাওয়ার ঠিক আগে ছেলেটা খুব দ্রুত এসে তাকে ধরে ফেলে।অনিলা তার কাধে খুব ঠান্ডা আর নরম হাতের ছোয়া পায়।অনিলা নিজেকে সামলে নেয়।ছেলেটা অনিলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।


অনিলা তার চোখ নামিয়ে নিচের দিকে চেয়ে থাকে।কিন্তু সে তার চোখ দুটো কে বেশিহ্মন নামিয়ে রাখতে পারলো না।
অনিলা তার সামনে দাড়ানো অসাভাবিক সুদর্শন যুবকের দিকে মাথা তুলে হা করে তাকিয়ে থাকেলো।এতে যদি তার ঘাড় ব্যাথা হয়ে ছিড়েও যায় কোন আফসোস থাকবেনা।ছেলেটার শরীর থেকে আসা মিষ্টি সুবাশ টা আরো তীব্র ভাবে অনিলার মন কে শিহরিতো করে তুলে।
মাগরিবের আজানের ধ্বনি শুনে অনিলার হুশ ফিরলো। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। কতহ্মন এভাবে তাকিয়ে ছিলো অনিলা বলতে পারবেনা।ছেলেটি মিটি মিটি হাসছে অনিলাকে এভাবে দেখে।অনিলা ভিষন লজ্জা পায় এবার।আর বেশিহ্মন দাঁড়িয়ে থাকলে সারা জনমের মতো এখানেই মুর্তির মতো স্থির হয়ে যেতে হবে তাকে!
অনিলা ছাদের দরজার দিকে যেতে নেয়।
-- এই যে শুনুন"ছেলেটা অনিলাকে পেছন থেকে ডাক দেয়।অসাধারণ ভরাট পুরুষালি কন্ঠ তার।এমন কন্ঠের অধিকারী কাউকে উপেক্ষা করার দুঃসাহস কোন মানুষের আদৌ আছে কিনা অনিলার জানা নেই!সে ফিরে তাকায়।কিন্তু প্রানপনে চেস্টা চালিয়ে যায় তার চোখের দিকে না তাকানোর।
--
জি,বলুন।অনিলার হাত ঘামতে থাকে।সে ওড়নার ঝুলে থাকা অংশ দিয়ে হাত মুছতে থাকে।
--"
আমি আহমাদ। আপনাদের নতুন প্রতিবেশী। তিন তলায় উঠেছি কিছুদিন আগে।"
ছেলেটা অনিলার দিকে এক দৃস্টিতে তাকিয়ে বলে।
অনিলা মনে মনে উচ্চারন করে "অাহমাদ"!কি চমৎকার নাম!
--
আফসানা আপনার...অনিলার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই আহমাদ বলে,
--"
জি, আফসানা আমার ছোট বোন।ও অামাকে বলেছেলো অাপনার কথা।
অাহমাদের কথা শুনে অনিলা মনে মনে ভাবে,ছেলেটা কিভাবে বুজলো যে উনার বোন যার কথা বলেছে,অামিই সে?"অন্য কেউতো হতে পারতো। মা বলেছিলো একবার, বাড়িওয়ালার বোনের ফ্যামিলি এদিকে কাছাকাছি কোথায় যেনো থাকে।তার মেয়েরা নাকি প্রায় অাসে।ছাদে উঠে ছবি টবি তোলে।অবশ্য তাদের সাথে দেখা হয়নি অনিলার।ওদের কেউ যদি হতো!!অনিলা ভাবতে থাকে।
-- "
আমি আসলে আপনাকে দেখেই বুঝেছি আপনিই যে অনিলা" আহমাদের এই কথাটা শুনে অবাক হয়ে যায় অনিলা।এই দুই ভাইবোনের কি কোন স্পেসাল টেকনিক জানা আছে নাকি মানুষের মনের ভাবনা বুঝে ফেলার?আজবতো!!
-- "
আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম" আহমাদ মুচকি হাসি দেয়। অনিলা অনিচ্ছা সত্ত্বেও এবার আহমাদের চোখে চোখ রাখে।
এক বারের জন্যও দুজনের কারোরি চোখের পলক পরেনা।হঠাৎ অাহমাদের হাত থেকে তার বাঁশি টা পরে যায়।অাহমাদ বাঁশিটা উঠাতে যায়,আর তখনি অনিলা এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে যায়।সে যদি তখন একবারো পেছনে ফিরে তাকাতো তাহলে দেখতে পেতো,আহমাদের জ্বল জ্বল করা সবুজ দুটি চোখ অনিলার দিকে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে অাছে!!
অনিলা বাসায় যেয়ে দেখে লাবনি ইসলাম অফিস থেকে চলে এসেছেন।অনিলা কে দেখে তিনি বল্লেন,"কিরে,কোথায় ছিলি এতোহ্মন?আমি সেই কখন এসেছি"
--
ওহহো,সরি মা।একা একা বোর লাগছিলো তাই ভাবলাম একটু ছাদে যেয়ে বাতাস খেয়ে আসি।"
অনিলার ছাদে যাওয়ার কথা শুনে হঠাৎ রেগে গেলেন লাবনি ইসলাম।তিনি ধমক দিয়ে বল্লেন,
"
তুই আমাকে না জানিয়ে ছাদে গেলি কেনো? অনিলা মায়ের এমন আচরণে ভয় পেয়ে যায়।সে
মিন মিন করে মা কে বললো " কি করে তোমাকে জানাবো মা?কখনো একটা ফোনও তো কিনে দাওনি।সারাদিন বাসায় একা একা থাকি।কতোহ্মন আর শুধু বই পড়ে কাটিয়ে দেয়া যায়?এতো দূরে বাসা নিয়েছো,কেউ আসতেও পারেনা।" কথা গুলি বলতে যেয়ে অনিলার কান্না চলে আসে।সে তার নিজের রুমে চলে যায়।
লাবনি ইসলাম নিজের রুমে না যেয়ে ড্রইং রুমেই একটা সোফায় বসে পড়েন।তিনি নিজেও বুঝেন অনিলাকে তিনি অনেকটা বন্দীদের মত করেই রেখেছেন।এমনকি একটা সাধারন মোবাইল কখনো কিনে দেননি। কোথাও গেলে অনিলাকে তিনি এক মূহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেননি।সে কার সাথে মিশবে,কত জনের সাথে বন্ধুত্ব করবে সবই তিনি ঠিক করে দিয়েছেন।
কিন্তু কি করবেন লাবনি ইসলাম।
এসব নিয়মের মধ্যে অনিলাকে রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলোনা তার।অনিলা যে তার নিজের সন্তান নয়।সে তো একজনের আমানত!
অনিলা নিজের বেডের উপর একটা কুশন নিয়ে বসে আছে।টপ টপ করে চোখ থেকে পানি পড়ছে তার।মা কেনো তাকে বকলো?সে তার বাম হাত দিয়ে ডান চোখের পানি মুছে।পানি মুছতে যেয়ে অনিলা তার বাম বাহুতে একটু ব্যাথা পায়।সে তার জামার হাতা কিছুটা সরিয়ে রুপা দিয়ে বাধানো তাবিজটা একটু নাড়িয়ে নেয়।তাবিজ টা টাইট হয়ে এসেছে। এটাকে বদলিয়ে আরেকটা লাগানোর সময় হয়েছে!
প্রতি বছর অনিলার মা লাবনি ইসলাম একটা নির্দিষ্ট সময় মেনে নিজ হাতে তাবিজটা বদলিয়ে দেন।অনিলা অনেক বার জিজ্ঞেস করেছে মা কে,এটা কিসের জন্য? মা কখনোই কিছু বলেনি তাকে।এই তাবিজ টা যেনো কেউ কখনো না দেখতে পায় এজন্য খুব ছোট থেকেই অনিলা কে বড় হাতার জামা পরাতেন লাবনি ইসলাম।
অনিলার রুমের দরজার সামনে যেয়ে দাড়ালো লাবনি।মা কে দেখে অভিমানে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় অনিলা।একটা চেয়ার টেনে বসেন লাবনি।মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেয়
-- "
ছাদে কি একাই গিয়েছিলি নাকি?হাসিমুখে জিজ্ঞেস করেন তিনি।অনিলার মনে হলো তার মা যেনো ভুলেই গেসেন যে একটু আগে তিনি অনিলা কে বকেছেন!অনিলার খুব অভিমান হয় মায়ের সাথে।কিন্তু সাথে সাথেই তার আহমাদের কথা মনে পরে তার।ছাদে সে একা ছিলো না।আহমাদ নামের একজন অতি সুদর্শন যুবক ছিলো তার সাথে।আহমাদের চেহারা চোখে ভাসতেই অনিলার মন এক অজানা আনন্দে ভরে উঠে!
কিন্তু মাকে আহমাদের কথা বলা যাবেনা, অনিলা মনে মনে ভাবে।এমনকি তারা যে অনিলাদের নতুন প্রতিবেশী একথাও মা কে বলবেনা সে।কারন অনিলার মা একদম পছন্দ করেন না যে সে কারো সাথে মিশুক!
--
কিরে,কিছু বলছিস না কেনো? লাবনি ইসলাম অনিলার তাকিয়ে আছেন।
--
কার সাথে আর যাবো? এখানে কি কেও আছে নাকি?অনিলা গাল ফুলিয়ে উত্তর দেয়।
আমার হ্মিধে পেয়েছে।নুডুল্স বানাবো। অনিলা বসা থেকে উঠে রান্না ঘরের দিকে চলে যায়। যখন মায়ের সাথে অভিমান হয় অনিলার,তখন সে নিজে নিজে নুডুল্স বানিয়ে খায়।এটা তার অনেক দিনের অভ্যাস।অনিলার মায়ের সাথে তার অভিমানের একমাত্র বহিঃপ্রকাশ এটা!


                                                                           চলবে .......... 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা