গল্পঃ সারপ্রাইজ


                                                                গল্পঃ সারপ্রাইজ
                                                         লেখকঃ ইস্তিয়াক হোসাইন  

 ১. ক্রমাগত ঝন ঝন শব্দ আর মৃদু কম্পনের ধাক্কায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। অল্প করে চোখ জোড়া খুলতেই অস্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম, পানির বোতলটা কাঁপছে, পাশে রাখা চায়ের কাপটাও।
আমি সোজা হয়ে উঠে বসলাম। জানালার বাইরে চোখ চলে গেলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। বৈশাখ মাসের ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ। আকাশ ভর্তি নক্ষত্র, কিন্তু আজ চাঁদ নেই। ট্রেইন চলছে একটা ব্রিজের উপর দিয়ে। ঝন ঝন শব্দের সাথে মৃদু কম্পন হচ্ছে। ব্রিজের সাথে বেষ্টনী দেয়া লোহার খুঁটিগুলো যেনো ট্রেইনের সাথে পাল্লা দিয়ে দৌঁড়াচ্ছে। অল্প আলোতেও নদীটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নদীটার একটা নাম আছে হয়তো। কিন্তু নামটা আমি জানিনা। আমার মুখোমুখি যে মেয়েটা বসে আছে তার কাছ থেকে জানতে চাইলে কেমন হয়?। মুখে গুমরা ভাবটা রেখেই হয়তো বলবে নদীটার নাম। তবুও বলবে, আমার বিশ্বাস। কারণ, সে এই নদীটার নাম জানে।
মেয়েটা এখন একটা বই পড়ছে। আমি ঘুমাবার পূর্বেও এই বইটা হাতে দেখেছিলাম। ট্রেনে চলতে শুরু করেছিলো রাত আটটায়। এখন বাজছে দশটা। মাঝখানে মনে হয় আমি ঘন্টা খানিক ঘুমিয়েছিলাম। তখন খালি চোখে বই পড়ছিলো। এখন চোখে চশমা লাগিয়েছে। বইয়ের নাম ফলস্ ইম্প্রেশান। জেফরি আর্চারের লিখা। মনে হয় প্রায় শেষের দিকে। খুবই মনোযোগী হয়ে পড়ছে। তার এই গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়া আমার চিরচেনা।
"আপনার টিকিটটা দিন"
আমি টিকিট চেকারের দিকে তাকালাম। বয়স্ক একজন মানুষ। বয়স বৃদ্ধির কারণেই মনে হলো চেহারার উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলেছে। আমি শার্টের বুক পকেটে হাতের দুইটা আঙুল রাখলাম। তিনটা পঞ্চাশ টাকার নোট বেরিয়ে আসলো। বুক পকেটে টিকিট পাওয়া গেলোনা। তারপর মানিব্যাগ বের করলাম, প্রত্যেকটা ভাজে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখি সেখানেও টিকিট নেই। বুড়ো লোকটা আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমার টিকিট খুঁজে না পাওয়াতে তাকে প্রচণ্ড বিরক্তও দেখালো, মনে হয় বড় ধরনের একটা জরিমানা লিখার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হয়তো এক্ষুনি বলে ফেলবে, ---- "টিকিট লাগবেনা। টাকা দেন। দেখে মনে হয়না চুরি করে ট্রেনে উঠেছেন। জরিমানা অর্ধেক দিলেই হবে, সমস্যা নাই। ঘটনা এখানেই মীমাংস হয়ে যাক।"
---আমি টিকিট কিনেই ট্রেনে উঠেছি। দুইদিন আগেই কিনে রেখেছিলাম। জরিমানা দিতে হবে কোন দুঃখে? একটু সময় দিন খুঁজে বের করছি।
এই মানুষটা তখন হয়তো বলে বসবে, --"যা করার জলদি করেন। মাথার উপর কাজ একটা না যে আপনারে নিয়ে পড়ে থাকবো। প্রতিদিনের নাটকগুলো এখন আর সহ্য হয়না। একজন টিকিট খুঁজে পাইনা, অন্যজন বাসায় ফেলে আসে।"
আমি অস্থির ভঙ্গিতে টিকিট খুঁজতে লাগলাম। ঘুমাবার আগে তো পকেটেই ছিলো, সেখান থেকে কিভাবে নিখোঁজ হলো আমি ভেবে পাচ্ছিনা।
আমার মাঝে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে দেখে মেয়েটা এবার বলে উঠলো, "আপনার ব্যাগের দুই নম্বর পকেটে দেখুন, ঘুমাবার আগে আপনি সেখানটাই রেখে ঘুমিয়েছেন"
চেইনটা আলতো করে টেনে ব্যাগের পকেটে হাত দিতেই টিকিটের সন্ধান পেলাম। টিকিট চেকারের দিকে দুইটা টিকিট এগিয়ে দিয়ে আমি বললাম, ----"আমরা দুইজন একসাথে।"
|
২. আমি লীনাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, "জানতেই যখন এতোক্ষণ বলোনি কেন?
-----"আপনার অভিনয় দেখছিলাম, খারাপ না! ভালোই করেছেন।" লীনা কথাটা বলার জন্যেই বলেছে, তার মনোযোগ বইয়ের মধ্যে।
----আচ্ছা! তাহলে আমি অভিনয় করি?
লীনা কথার উত্তর দিলোনা। সে জানে উত্তর দিলেই কথা বাড়বে। কথা বাড়ানোর মত মন মানসিকতা এখন তার নেই। এখনো রাগ চেপে বসে আছে বুঝতে পারছি। সেই কারণটা নাহয় একটু পরেই বলি। লীনা গম্ভীর, তার এই গম্ভীর ভাবটা আমাকে অতীতের স্মৃতি গুচ্ছের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কবে যে সাতটা বছর পেরিয়ে গেলো। বুঝতেই পারিনি। ছোট করে শ্বাস নিলাম আমি। জানালা দিয়ে আসা বাইরের তাজা বাতাসটা গায়ে লাগছে। চমৎকার!... আমি ডুবে গেলাম স্মৃতির সাগরে।
*****
ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে। ক্লাস টেনের ফাইনাল মডেল টেস্ট পরীক্ষা তখন শেষ হয়েছ। ভাগ্যিস! ঠিকঠাক পার করলাম পরীক্ষাটা। নাহয় ভাঙ্গা হাত নিয়ে কিভাবে পরীক্ষা দিতাম সেই চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে পড়ি। শেষ পরীক্ষার দিন ঘটনাটি ঘটলো। স্কুলের সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত পায়ে নামছিলাম। জুতোর ফিতে কবে যে বাঁধন হারা হয়ে গেলো আমার জানাই ছিলোনা। ব্যস! পায়ের সাথে ফিতের প্যাঁচ লেগে এঁটে গেলো অন্য পায়ের সাথে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দড়াম করে পড়ে গেলাম। নীচে... তারপর আরো নীচে.. যেখানে সিঁড়ির তাকগুলো সমাপ্ত হয়েছে, গড়াতে গড়াতে আমি সেখানে থেমে গেলাম। এক মুহুর্তে কি ঘটে গেলো আমি বিন্দুমাত্রও বুঝে উঠতে পারিনি।
এই পুরো সময়জুড়ে একটিমাত্র শব্দ তখন আমার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। ক্লাসের সব চেয়ে চুপচাপ বালিকাটি যখন বলে উঠলো, "জুতোর ফিতে ঠিক করুন আপনার"
এরকম না যে এই কণ্ঠ আমার জীবনে আমি প্রথমবারের মতো শুনেছি, স্থির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পড়া মেয়েটিকে আমি প্রথমবারের মতো দেখছি। কিন্তু, তার বিস্মিত দৃষ্টি যখন আমার চোখ বরাবর এসে ঠাঁই নিলো। তখনই মনে হয় আমি আমার সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। এক্সিডেন্টটা খুব দ্রুত সময়ে ঘটেছিলো। কিন্তু এই ভয়ংকর রোমাঞ্চকর মুহূর্তটা আমার স্মৃতিতে চিরকালের জন্য স্থান করে নিলো।
---"প্রকৃতি বড়ই অদ্ভুত! দূর্ঘটনা আর রোমাঞ্চকর মুহূর্তটা আমার জীবনে ঠিক একই সাথেই আয়োজন করে রাখে।"
|
৩. জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে স্কুলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শুরু হচ্ছিলো। আর আমার ডান হাতে ব্যান্ডেজ। ডাক্তার বলে দিয়েছে, এক মাসের কম সময়ে হাত ঠিক হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। হাড়ে ফ্রাকচার আছে। এক মাসের লম্বা একটা বিশ্রাম দরকার। যতো বেশি সম্ভব হাত নাড়াচাড়া কম করাই শ্রেয়।
ক্রিকেট আর সেই সকল খেলায় নিজের নামটা বসাতে পারলামনা, যেগুলোতে ফিজিক্যাল এক্টিভিটি বেশি। আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্ত, তখনো আমি জানতাম না আমার জীবনটা ভিন্ন একটা মোড়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
দাবা খেলার লিস্টে নিজের নামটা বসিয়ে দিলাম। আমি যে খুব ভালো একটা দাবা খেলা জানি তা না। যেহেতু বাকি খেলা গুলোতে আমার অংশগ্রহণ করার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই এটা দিয়ে নিজের মনকে কোনরকম সান্ত্বনা দেয়া। দাবা খেলা আমার পছন্দের না। বিরক্তিকর একটা খেলা। আমার মনে হয় এই খেলাটা এসেছে বুড়ো মানুষদের জন্য। অন্তত আমার জন্য না।
যখন জানলাম লীনাও এই খেলায় অংশ নিয়েছে। তখন আমি নড়েচড়ে বসলাম। কেনো যেনো, মমে মনে খুশিই হয়েছিলাম। ছেলেদের মধ্য থেকে আটজন আর মেয়েদের মধ্য থেকে আটজন করে মোট ষোল জন এই দাবা খেলায় নিজের নাম লিখিয়েছিলো।
ছেলেমেয়েদের মধ্যে দুইটা গ্রুপ ভাগ হলো, "এ" এবং "বি"। দুটো গ্রুপেই নকআউট পর্বে খেলা হবে। সমীকরণটা এরূপ আট-চার-দুই-এক।
তারপর ফাইনাল ম্যাচ হবে গ্রুপ 'এ' এবং গ্রুপ 'বি' এর বিজয়ীদের মধ্যে। ছেলে এবং মেয়ে। যে কোনো একজন বিজয়ী হবে।
|
৪. অবশেষে দাবা ম্যাচ শুরু হলো। প্রথম জনকে আমি খুব সহজে হারিয়ে দিলাম। খুব একটা কষ্ট হয়নি। আশরাফ ভাইকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। আশরাফ ভাই একজন রিকসা চালক। ওনার মত দাবা খেলোয়াড় আমি এখনো পর্যন্ত দেখিনি। আমি নিজের চোখে দেখেছি আশরাফ ভাইয়ের খেলার পদ্ধতি। খুব চতুর বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন। সমাজের অনেক বড় বড় দাবাড়ুকে তিনি হারিয়েছেন।
আমার সাথে ভালো পরিচয় আশরাফ ভাইয়ের সাথে। তিনি আমাকে কিছু শর্টকাট ট্যাকনিক শিখিয়ে দিয়েছেন। যে ট্যাকনিক গুলোদিয়ে আনাড়ি টাইপ দাবাড়ুকে খুব সহজে কাবু করা যায়। সেরকম একটা ট্যাকনিক কাজে লাগিয়ে আমি দ্বিতীয় ম্যাচটাও জিতে গেলাম। এই খেলাটা আমার জীবনের এতো সিরিয়াস হয়ে যাবে আমি কল্পনাও করিনি।
কারণ, অন্যদিকে সমান হারে জিতে আসছে লীনা। তার সাথে মুখোমুখি দাবা খেলার একটা মুহূর্ত হবে আমার। এই চিন্তা মাথায় আসতেই আমি আরো প্রেকটিসে মনোযোগী হতে লাগলাম। তার নজরে নিজেকে প্রকাশ করার একটা সুযোগ।
মেয়েদের ফলাফল নিশ্চিত হলো। লীনা মেয়েদের মধ্য থেকে প্রথম হয়েছে। দাবা খেলায় অসম্ভব ভালো সে। এতো ভালো যে আমি আগে জানতাম না বিষয়টা।
কিন্তু আমাদের ফলাফল তখনো বাকি। আমাকে এখন যার সাথে টপকাতে হবে, সে জুনিয়রদের মধ্যে গ্রেন্ড মাস্টার পর্যায়ের। এরকম প্রতিযোগিতায় জেতা জুবায়েরের জন্য কোন ব্যাপারই না। পুরষ্কার আর খেতাব ভর্তি তার আলমারি।। তাকে হারানো আমার পক্ষে সম্ভব না। কি করবো কিছুতেই কিছু ভেবে পেলাম না। অন্যদিকে লীনার এতো কাছে এসেও ফিরে যাওয়া অসম্ভব।
আমি আশরাফ ভাইয়ের কাছে গেলাম, ঘরে তালা মারা। তিনি গেলেন গ্রামের বাড়িতে। সকালে ম্যাচ শুরু হবে। আমি রাতভর ঘুমাইনি। তবে সকাল সকাল একটু চোখে লেগে এসেছিলো। উঠতে গিয়ে টের পেলাম। হাতে প্রচণ্ড ব্যথা করছে। সাথে যুক্ত হয়েছে গায়ে জ্বর। জুবায়েরকে যদি অন্যভাবে কন্ট্রোল করা যেতো। বেটাকে দমক-টমক দিয়ে যদি কোন কাজ হতো..... নাহলে আর কি, আমি তো নাছোড়বান্দা। হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করে নিতাম।
আমার পক্ষে এখন অন্যকিছু করা সম্ভব না। শরীরের অবস্থাও ভালো না। আমি নিজের শরীরটা টেনে স্কুল পর্যন্ত নিয়ে গেলাম।
সেমিফাইনাল ম্যাচ। আমি শুরু করলাম। চার চালের একটা ট্যাকনিক দিয়ে। আশরাফ ভাইয়ের ফেভারিট মুভগুলোর মধ্যে একটা। কোন আনাড়ি দাবাড়ু হলে চার চালেই তাকে হারানো সম্ভব এই ট্যাকনিক দিয়ে। কিন্তু আমার সামনে যে ছিলো সে মোটেও আনাড়ি ছিলোনা। কিন্তু তাকে বিভ্রান্ত করতে আমি এটা দিয়ে সুন্দর একটা শুরু করতে পারি।
পরপর আমি আমার পাওয়ারগুলো হারাতে লাগলাম। দুইটা ঘোড়া আর মন্ত্রি গেলো ভেস্তে। পুরা খেলার অর্ধেকটাই হাত থেকে ফসকে গেলো। অতিরিক্ত গায়ে জ্বর থাকার কারণে, মাথা ব্যাথা আর বমি ভাবটাও আমাকে মিলেমিশে আক্রমণ শুরু করলো। ---"অহহ লীনা আমার অবস্থাটা তুমি একবার যদি বুঝতে।" নিজের মনেই বললাম।
শেষপর্যায়ে একটা আশার আলো উদয় হলো। জুবায়ের বারে বারে দুইটা ভুল চাল দিয়েছে। আমি উত্তেজনা চেপে রাখলাম। যাতে জুবায়ের কোন ভাবেই অনুমান করতে না পারে, আমি তার ভুলটা বুঝতে পেরেছি। আর এই সুবর্ণ সূযোগটা আমি কিছুতেই হাত ছাড়া করার প্রশ্নই আসেনা। আমার মুভগুলো দিয়ে জুবায়েরকে বুঝিয়ে দিলাম, আমিও কম না। লীনার সাথে মুখোমুখি একটা দাবা ম্যাচের কথা চিন্তা করলাম। তার মনোযোগী দৃষ্টি আমার কল্পনায় উঁকি দিচ্ছিলো তখন।
---"চেক মেট"
বড়শির আগাতে যেমন সুস্বাদু খাবার লাগিয়ে মাছ ধরা হয়। জুবায়ের ঠিক একই ভাবে আমাকে তার ফাঁদে আটকে নিলো। তার ভুল চাল ভেবে খুশিতে গড়াগড়ি খাওয়া আমি, বুঝতেই পারিনি এটা তার ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিত একটা ফাঁদ।
মাথার ভেতর ঝি ঝি করছিলো ক্রমাগত। তারপর তিন তলার সিড়ির তাঁকে বসে পড়লাম। অল্প কিছুক্ষণের জন্যে আমি সেন্স হারালাম। কারণ, আমার গায়ের জ্বরটা অতিমাত্রায় বেড়ে গিয়েছিলো।
একটা মৃদুস্বরে চিৎকার শুনেছিলাম, "রাফি" তারপর মনে হলো কেউ আমার দিকে দ্রুত পায়ে ছুটে আসছে।
---"প্রকৃতি বড়ই অদ্ভুত! দূর্ঘটনা আর রোমাঞ্চকর মুহূর্তটা আমার জীবনে ঠিক একই সাথেই আয়োজন করে রাখে।"
|
৫. লীনার সাহসের পরিচয় আমি সেই দিন পেলাম যখন সে আমার স্বাস্থ্যের খবরাখবর নিতে আমাদের বাসায় চলে আসে। দরজার সামনে তাকে দেখে আমার হৃদস্পন্দন লাফালাফি শুরু করে দিয়েছিলো।
-----"হা করে তাকিয়ে আছেন যে, ভেতরে আসতে বলবেন না?"
তার কথার উত্তরে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। পরবর্তী আমার মা তাকে ঘরের ভেতরে ডেকে নিলো। সে আমার জন্য স্কুল ব্যাগ ভর্তি আম নিয়ে আসলো। লীনার বাবার আম বাগান আছে। সেই বাগানের আম কতো কষ্টে কাঁধে বহন করে নিয়ে আসলো, শুধু আমার জন্যে।
খুশিতে আমি মনের মধ্যে ছন্দ হারা হয়ে গেলাম। মার সাথে খুব তাড়াতাড়ি মিশে গেলো সে। অল্প সময়ে দুজনের ভালোই জমেছে, বসার ঘর থেকে হাসি ঠাট্টার আওয়াজ আসছে। এই মেয়ে এতো কথা বলতে পারে এর আগে কখনো কল্পনা করিনি। আমি আমার রুমে নাচানাচি করছি। সেই ধ্যানে আমি ফ্লোরে গ্লাস দিলাম।" ধুর! আমি আস্ত একটা নিকাম্মা।"
তারপর সেই ক্ষণ এলো যখন লীনা আমার পড়ার রুমে প্রবেশ করলো। শেষবারের জন্য দেখে যেতে । তারপর সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "হাতের অবস্থা এখন কেমন?
---"ভালো।" কথাটা স্পষ্ট বলতে পারলাম কি-না আমার সন্দেহ ছিলো।
---গায়ে এখনো জ্বর আছে?
--খুব বেশি না। সামান্য। রাতের দিকে একটু বেড়ে যায়।
---আপনি কি জানেন? আপনি নিতান্তই একজন বোকা টাইপের মানুষ। কে বলেছে আপনাকে কম্পিটিশনে যেতে!! আপনি জানেন আপনার স্বাস্থ্য খারাপ। বাসায় রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু না, আপনি তো সিঁড়িতে ঘুরে ঘুরে পড়ে যাওয়ার টেকা নিয়ে রাখছেন। এখন বুঝেন।
আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। চেহেরায় অনুতপ্ত হওয়ার ভান করে বসে থাকলেও ভেতরে ভেতরে আমি মুন ওয়াক ড্যান্স করছিলাম, মাইকেল জ্যাকসনের মতো। লীনা তার ব্যাগ থেকে একটা মার্কার বের করে আমাকে পুনরায় বললো,----- "দেখি, আপনার ব্যান্ডেজ করা হাতটা একটু এগিয়ে দিন।" আমি আমার হাতটা তার হাতের দিকে এগিয়ে দিলাম। সে আমার হাতটা স্পর্শ পর্যন্ত না করে সাদা ব্যান্ডেজ এর উপর লিখে দিলো। MFH Be Careful..
আমি তাকে ধন্যবাদ দিলাম। ধন্যবাদ সব কিছুর জন্য।
সে আমাকে যেতে যেতে বলে গেলো। "আপনার স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখবেন। কোন একসময় আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।"
*****
অনেক দিন কেটে গেলো। কলেজ, ভার্সিটি আমরা এক সাথেই পার করলাম। তারপর আমরা দুজন বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলাম। বিয়ের প্রথম রাতে আমি জীবনের প্রথমবারের মতো তার হাতটি স্পর্শ করে, লীনাকে যে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছিলাম সেটা হলো, MFH লিখে সেদিন কি বুঝিয়েছিলে?
সে উত্তরে জানালো, "মাই ফিউচার হাজব্যান্ড"
***** *****
(পূর্বাভাস)
[ গাঢ় অন্ধকারে দুইটা ছায়ামূর্তি দেখা গেলো। দুজনে মিলে কিছু একটা করছে। ঠিকঠাক কাজটা করতে পারছেনা। কারণ, দুইজনই মাতাল। একজন দুলতে দুলতে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলো। আরেকটু হলেই রেইল লাইনে পড়ে মাথা ফেটে যেতো।
-জগু কামডা কি তুই ঠিক করতাছোস?
হারামজাদা চুপ থাক। লাইত্তি মাইরা পেঠের আঁতুড়ি বাইর কইরা ফেলমু। মালের টাকা কি তোর বাপে দিবো? শূয়রের বাচ্ছা। জলদি জলদি হাত লাগা ট্রেইন এক্কুনি আইয়া পড়বো।
নেশায় দুলছে জগু আর তার সাথী। এতো বড় লোহা বহন করে নিয়ে যাওয়া তাদের জন্য অনেক কষ্টসাধ্য হবে। "তুই যা এখন ঐ দূরে যাইয়া একটা লাল ত্যানা (কাপড়) লাগাই দিয়া আয়।"
নেশায় ডুবে থাকার কারণে লাল কাপড়টা রেইল লাইনে দিতে পারেনি মাতালটা। সে দিশাহীন অন্য পাশে চলে গেলো আনমনে বকতে বকতে। ]
***** *****
৬. রাতের গভীরতা বাড়ছে, ট্রেন ছুটে চলছে আপন গতিতে। লীনার বই পড়া শেষ। চোখজোড়া বন্ধ করে সীটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে সে, একদম চুপচাপ।
---লীনা চা খাবে? ফ্লাস্কে চা আছে। এক কাপ বানিয়ে দেই?
----চা খেতে ইচ্ছে করছেনা।
----"এখনো রেগে আছো? জরুরি কাজে চিটাগং যেতে হচ্ছে। সেখানে সপ্তাহ খানেক চলে যাবে। তোমাকে বাসায় কিভাবে একা ফেলে যায়? মা বেঁচে থাকলে। মায়ের কাছে তোমাকে নিশ্চিন্তে রেখে যেতে পারতাম। বাসায় একা একা থাকতে ভালো লাগবেনা তোমার। তাই ভাবলাম তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যায়।"
লীনার মন খারাপের কথাটা তো বলা হয়নি। হয়েছে কি, আজ সকাল থেকেই সে খুব আয়োজন করে রান্নাবান্না করেছে। রাতের জন্য। আমি যখন ক্লান্ত শরীর নিয়ে অফিস থেকে বাসায় আসলাম। আমি লক্ষ্য করলাম। লীনা আমাকে কিছু একটা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। কিন্তু আমি তার কথাটা শুনলাম না। ইচ্ছে করেই অমনোযোগী হয়ে কথাটা বলার সুযোগ দিলাম না তাকে। কারণ, আমি জানি সে কি বলবে। আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। বিয়ের দ্বিতীয় বছর। সে হয়তো আমাকে সার্প্রাইজ করতে চেয়েছিলো। এবং এটাও মনে করিয়ে দিতে চাইলো যে, আমি এবারো ভুলে গেছি দিনটা। তাইতো খালি হাতে বাসায় ফিরলাম। কিন্তু আসলে আমি ভুলিনি। শুধু অভিনয় করছিলাম যেনো, আমার কিছুই মনে নেই।
কারণ, আমি লীনার জন্য একটা বড় ধরণের সার্প্রাইজ প্লেন করে রেখেছি। চিটাগং এ তার প্রত্যেক পুরানো বন্ধুকে ইনভাইট করেছি। তার ফ্যামিলিও আছে। সুন্দর করে আয়োজন করা। ড্রিমি নাইট নামে একটা ইভেন্ট ক্রিয়েটরকে দায়িত্ব দিলাম। আজ রাতটাকে ড্রিমি করে তুলতে। তার প্রিয় ফুল দিয়ে পথ সাজিয়ে রাখতে।
সন্ধ্যায় লীনা যখন তার কথাটা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। আমি তখন বললাম, "লীনা, হাতের কাছে যা আছে প্যাক করে নাও। আমাদের চিটাগং যেতে হবে এক্ষুনি। আমি টিকেট করিয়ে এনেছি। সরি ডিয়ার খুব আর্জেন্ট একটা কাজ, যেতে হবে। আর খাবার যা আছে টিফিন করে রাখিও। আমরা সেখানে পৌঁছে এক সাথেই খাবো।
লীনা হঠাৎ রেগে গেলো। রাগটা আমাকে দেখালোনা। চেপে রাখলো। আমি লক্ষ্য করলাম সে বারবার ঢোঁক গিলছে। কান্না দমানোর জন্য সে এরকমটা করে থাকে। আমি সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। আমার অন্তরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। নিজেকে ধিক্কার দিলাম। অন্তত এক সঙ্গে বসে রাতের খাবারটা খাওয়া উচিৎ ছিলো। কতো যত্ন করেই না রান্না করেছে। কিন্তু ট্রেন আটটায় ছেড়ে দিবে। অন্যদিকে বারোটার আগে পৌঁছানোর একটা তাড়া আছে।
--"ঠিক আছে, আপনার কাজ আছে যখন যেতেই হবে" কথাটা বলার পর মুহূর্ত থেকে এখন পর্যন্ত সে চুপচাপ।
এভাবে মন খারাপ নিয়ে আমি বাকি পথটুকু পাড়ি দিতে চাইনি। টিফিন খুললাম। রুটির একটা টুকরো ছিঁড়ে চায়ে ডোবালাম। তারপর লীনার মুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, "এই নাও, খাও একটু।" এটা দেখে সে ফিক করে হেসে দিলো। সে হাসি পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর হাসি।
--কারো মন ভালো করার এতো সহজ ট্যাকনিক আপনাকে কে শিখিয়ে দিলো? হুম....। লীনা খেতে খেতে বললো।
--একটা হাদিস শরীফে পড়েছিলাম।
তারপর সে একটা টুকরো আমাকে খাইয়ে দিলো। "আচ্ছা তুমি যেনো আমাকে কি একটা বলতে চেয়েছিলে। ব্যস্ততার জন্য বিষয়টা ভুলে গিয়েছিলাম। এখন বলো।
--উহু.. এখন, এখানে বলা যাবেনা।
--কেনো?
--"কারণ আছে।" এবার দুজনে হেসে উঠলাম। আমরা দুই জনেই জানি আজ বিশেষ একটা দিন। কিন্তু এখনো একে অন্যকে জানানো হয়নি। সব কথা জানাতে হয় নাকি?
|
৭. গড় গড় শব্দের সাথে ট্রেন একটা ঝাঁকুনির মতো খেলো। আমি নড়েচড়ে বসলাম। লীনা ঠিক আছো তুমি? - হুম।
তারপর গড় গড় শব্দটা হঠাৎ বাড়তে লাগলো। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। ট্রেইনে কোন সমস্যা হয়েছে হয়তো। তারপর আচমকা এমনটা ধাক্কা অনুভব করলাম, যেনো একটা মহাশক্তি আমাকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই চিৎকার দিয়ে উঠলো। ট্রেনটা যেনো হাওয়াতে ভাসছে। আর ট্রেনের মধ্যে থাকা সমস্ত কিছু যেনো অভিকর্ষ বল হারিয়ে ফেলেছে। কার্বন ডাই-অক্সাইড রাখা লাল রঙের লোহার বোতলটা উঠে এসে লাগলো লীনার মাথা বরাবর। আমার বুকটা ধক্ করে উঠলো। ট্রেনের বগিটা কুমিরের মতো নিজেকে একবার ঘুরিয়ে মোচড় দিলো, ডিগবাজি খাওয়ার মতো করে।
নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই আমার। আমি ট্রেনের উপরে অংশের সাথে জোরালো ভাবে ধাক্কা খেলাম। প্রচণ্ড আঘাতটা অনুভব করতে পারলাম না। বগিতে রাখা বড় বড় ভারী ব্যাগগুলো আমাদের উপর আঁচড়ে পড়ছিলো। সীটের হ্যান্ডেলে লীনা খারাপ রকম চাপ খেয়ে আটকে গেলো। তীব্র ঝাঁকুনি অনুভব করতে হলো তাকে।
সমস্ত কিছু দশ সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটে গেলো। কিন্তু আমার মনে হলো এই যেনো অনন্ত কাল, এর শেষ কোথায় আমি জানিনা। তারপর নীরবতা চেয়ে গেলো চারপাশে। এই নীরবতাকে মনে করতে লাগলাম অভিশাপ। আমার মাথার মধ্যে ইইই ধরণের আওয়াজ হচ্ছে। ঝাপসা চোখে আমি হাতড়াতে লাগলাম লীনাকে। ডান হাতে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলাম। হাতটা বেঁঁকে গেছে আমার।
লীনার মাথার ক্ষত থেকে তরতর করে রক্ত ঝরছে। একটা কোণায় আটকে আছে লীনা। আমি বুক ফাটা চিৎকার দিলাম। এটা নিশ্চয়ই একটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। নাহ! এটা শুধুই একটা দুঃস্বপ্ন।
কিন্তু,কঠিন হলেও এটাই বাস্তব। ভারী ব্যাগগুলো এদিকওদিক ছুড়ে আমি লীনার কাছে চলে আসলাম। তার হাত কাঁপছে। আমি তার রক্তাক্ত হাতটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কেঁদে দিয়েছি। অহহ লীনা!!
রাতেই এই অন্ধকারে, নির্জন এই স্থানে সাহায্য করার মতো কি কেউ আছে? এক পলকেই জগতটা পাল্টে গেলো আমার। ধিক্কার দিলাম অসহায় নিজেকে। লীনাকে আরো একটু আড়ালে টেনে এনে তার মাথাটা আমার পায়ের উপর রাখলাম। বদ্ধ এই বগিতে ঠাসাঠাসি অবস্থা। লীনা এখনো কাঁপুনি দিয়ে উঠছে একটু পর পর। আমি তার হাতটা শক্ত করে ধরে বসে আছি। লীনা কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে আমাকে কিছু বলতে চাইছে। আমি তাকে আমার বুকের মধ্যে টেনে নিলাম। তারপর সে আমার কানের কাছে ফিসফিস ভাবে যে কথাটা বললো। সেটা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। নিজের কান দুটোকে চেপে রাখতে চেয়েও পারলাম না। এক্ষুনি মনে হয় আমার দম আটকে যাবে। লীনা আবারো করুণ কণ্ঠে আমাকে বললো, "আমাদের বাচ্ছাটাকে বাঁচাও রাফি।"
এই কথাটাই সে হয়তো আজ আমাকে বলতে চেয়েছিলো বাসায়। আমি বাবা হতে চলেছি। এই কথাটা আমি এই অবস্থায় মোটেও শুনতে চাইনি। এটা আমার আনন্দে আত্মহারা হওয়ার একটা সময়। কি অধম আমি। আমি প্রকৃতিতে গালি দিলাম, বড়োই নিষ্ঠুর তুমি!! নিষ্ঠুর..... নিষ্ঠুর। আটকে পড়া এই বিচ্ছিরি বগি থেকে আমি কিভাবে উদ্ধার করবো তাদের!!
আমি নিরেট, পাথরের মত নির্বোধ হয়ে গেলাম। লীনাকে শক্ত করে ধরে রেখেছি। হাজার হাজার বছর ধরে। এর শেষ কোথায়, আমার জানা ছিলোনা। আমার পৃথিবীটা এখন থেমে গেছে।
---"প্রকৃতি বড়ই নিষ্ঠুর! দূর্ঘটনা আর রোমাঞ্চকর মুহূর্তটা আমার জীবনে ঠিক একই সাথেই আয়োজন করে রেখেছে।"

***** ***** *****

Surprise




#তিন_বছর_পরে
জন্ম হওয়ার আগেই মৃত্যু হলো আমাদের বাচ্ছাটার। নিজের মধ্যে অনুতপ্তভাব অনুভব করি আমি। যদিও এটা একটা দূর্ঘটনা ছিলো।
জীবন কখনো থেমে থাকেনা। তার নিজস্ব একটা গতি আছে। সেই গতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে শিখতে হয়। একটা সময় পর্যন্ত লীনা অনেক কান্নাকাটি করেছে। তার চোখের উষ্ণ জলে আমার বুক ভিজেছে বহুবার। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। এই সময় ছেলেদের একটু কঠিন থাকতে হয়, আশ্রয় দিতে হয়। সবার জীবনেই সুখ দুখ আসে। এটাই নিয়ম। এই নিয়ম মেনে সবার এগিয়ে যেতে হয়। আমরাও পুনরায় একটা সুন্দর জীবন শুরু করেছি।
****
---উহু! আর কতোক্ষণ এভাবে চোখ বন্ধ রাখতে হবে?
----এইতো হয়ে গেছে.... এবার চোখ খুলে দেখতে পারো।
সার্প্রাইজটা দেখে লীনার চোখজোড়া আনন্দে নেচে উঠলো।

***** সমাপ্ত ****

Credit By :  Istiak Hossain

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা