একজন বোকা মানুষের গল্প

একজন বোকা মানুষের গল্প

লেখকঃ অতন্দ্র প্রহরী  


একজন বোকা মানুষ"... নানান জায়গায় নিজের বর্ণনায় এই কথাটাই লিখে রাখি। পরিচিত মানুষজন হাসে। আমি যে বোকা, এটা তারা মানতে চায় না। তাদের নাকি বিশ্বাস হয় না। তাতে অবশ্য আমার বোকামি একটুও কমে না। বরং বিভিন্ন কাজে আমি তার নীরব প্রমাণ রেখে যাই। তারপর সেগুলো লুকানোর চেষ্টা করি। তখন কেউ কেউ অবাক হয়ে বলেই বসে বোকার মতো ওরকম একটা কাজ কীভাবে করলাম আমি! উত্তর দেয়ার কিছু থাকে না। বোকার মতো হাসি।
 
আমার বৈষয়িক বুদ্ধিও খুব কম। গণিতে মোটামুটি ভালো হলেও বাস্তব জীবনের হিসেবনিকেশে খুব কাঁচা। রেস্তোরাঁয় বন্ধুদের সাথে খাওয়া শেষে বিল সমান ভাগে ভাগ করার পর যখন কেউ কোনো একটা নোট চেয়ে নিয়ে হিসেব মিলিয়ে অন্য আরেকটা নোট দেয়, আমার মাথা সহজে কাজ করে না। আবার কেউ যখন পূর্বাচলে জমি কেনা বা ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড নেয়া প্রসঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে, সেটাও দুর্বোধ্য লাগে শুনতে। খুব মনোযোগ দিয়ে মাথা ঝাঁকাই। যেন সব বুঝতে পারছি। এবং বোকার মতো হাসি।
 প্রচলিত অর্থে টাকাপয়সার প্রতি আমার আগ্রহ বা মায়া আসলেই কম। নিজস্ব কিছু নীতি আছে অবশ্য। সেগুলো মেনে চলার চেষ্টা করি। সবসময় পারি যে, তা-ও না। তবে সেটা নিয়ে আফসোস হয় না। ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ের তাড়না অনুভব না করায় এই বিষয়েও চূড়ান্ত অনীহা। কেউ কেউ বলে দূরদৃষ্টির অভাব। সেটা শুনেও আমি বোকার মতো হাসি। তবে সঞ্চয় যে একেবারেই নেই, তা কিন্তু না। চাকরিতে ঢোকার দেড় বছরের মধ্যে একটা সঞ্চয়পত্র কিনেছিলাম। "নির্দিষ্ট পরিমাণ" বিনিয়োগ থাকলে নাকি অতিরিক্ত আয়কর দিতে হয় না, সেজন্যই মূলত কেনা। কয়েক মাস আগে হঠাৎ করেই সঞ্চয়পত্রটার কথা মনে পড়ল। তার আগ পর্যন্ত সেটা নিয়ে কোনোরকম চিন্তাও আসে নি মাথায়। বাসায়ই কোথাও না কোথাও রেখেছি, এটা মোটামুটি নিশ্চিত, তবে ঠিক কোথায় যে রেখেছি, তা মনে পড়ছিল না। শুধু নিশ্চিত ছিলাম খুঁজলেই পাওয়া যাবে। ওদিকে গড়িমসি করে খুঁজতেও ইচ্ছে করে না। এভাবে এক মাস কাটলো। তারপর আরেক মাস। তারপর মনে হলো এবার একটু খোঁজাখুঁজি করা দরকার। কারণ কবে যে ওটার মেয়াদ শেষ হবে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম না।


একজন বোকা মানুষের গল্প

দুঃখজনক কিংবা মজার ব্যাপার হলো, ঘরের বিভিন্ন জায়গায় নিজের তৈরি ছোট ছোট কাগজের পাহাড় ঘেঁটেও সঞ্চয়পত্রটা পেলাম না। প্রথম দফায় ব্যর্থ হয়ে কয়েকদিন বিরতি দিয়ে আবার শুরু করলাম খোঁজাখুঁজি। এবারও না পেয়ে ভাবলাম হয়ত অফিসে রেখেছি। খুঁজলাম। সেখানেও নেই। এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিয়ে ধরেই নিলাম যে ওটা আর পাওয়া যাবে না। তারপর গেলাম ব্যাংকে।
হারানো সঞ্চয়পত্র পুনরায় ইস্যু করাতে অনেক নিয়মকানুন। সবার আগে ব্যাংকে একটা দরখাস্ত করতে হবে সঞ্চয়পত্রের নগদীকরণ বন্ধের জন্য। এতে করে অননুমোদিত কেউ হাতে পেলেও সেটার মূল্য থাকবে না কোনো। এরপর থানায় জিডি করতে হবে। প্রচার বেশি, এমন দুইটি সংবাদপত্রে "হারানো বিজ্ঞপ্তি" দিতে হবে। দেড়শ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষরসহ নিজের ছবিযুক্ত একটি এফিডেভিট জমা দিতে হবে। আর ব্যাংককে ইনডেমনিটি বন্ডের জন্য দিতে হবে দেড়শ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প পেপার। এরপর বৈধ কোনো পরিচয়পত্রসহ সবকিছু ব্যাংকে জমা দিতে হবে। ব্যাংক তখন সর্বোচ্চ প্রায় চল্লিশ দিন সময় নিবে সঞ্চয়পত্রটির একটি প্রতিলিপি ইস্যু করতে।

আমি যে শুধু বোকা বা বৈষয়িক বুদ্ধি কম, তা না, আমি রীতিমতো ঈর্ষা করার মতো একজন অলস মানুষ। পৃথিবীর সমস্ত ঝামেলা দূরে রাখার আপ্রাণ, এবং বলাই বাহুল্য, বৃথা চেষ্টা করি সবসময়। ব্যাংকে দাঁড়িয়ে তখন মনে হচ্ছিল এটা নিশ্চয়ই খুব খারাপ কোনো একটা স্বপ্ন! নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা আর কি। একে তো সঞ্চয়পত্র হারানোর জন্য নিজের উপর অসম্ভব বিরক্ত, তারপর আবার নিয়মকানুনের যে বহর দেখলাম, তাতে মাথা প্রায় খারাপ হবার যোগাড়! প্রথম কাজটা অবশ্য খুব সহজেই হয়ে গেল। তাৎক্ষণিকভাবে দরখাস্ত একটা লিখে ব্যাংকে জমা দিয়ে দিলাম। এরপর জিডি করে ফেললাম সেদিনই। সেখানে হলো আরেক কাহিনি। থানার ভদ্রলোকটা একগাদা কথা শুনিয়ে দিলেন। জিডিতে কেন বাবা-মায়ের নাম দিলাম না, বাসা মিরপুর কিন্তু গুলশান থানায় কেন গিয়েছি, স্বাক্ষর কেন ইংরেজিতে, বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে কী লাভ হলো তাহলে, ফেব্রুয়ারি মাসে মঞ্চে উঠে বাংলায় গান গেয়ে আবার ইংরেজি নিয়ে মাতামাতি করি নিশ্চয়ই, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কী, কোথায় চাকরি করি, কোম্পানির কাজ কী, ইত্যাদি ইত্যাদি। সবকিছুর পর আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যে মূল্যহীন, তা বেশ পরিষ্কার ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন তিনি। দুয়েকটা কথার জবাব দিতে গিয়ে তার পালটা কয়েক পশলা কথা শুনে আগ্রহ হারিয়ে বাকি সময়টা চুপচাপই থাকলাম।

মূল সমস্যার সম্মুখীন হলাম এরপর। প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট কোথায় পাবো, সেই চিন্তা। একজনের কাছে খোঁজ পেয়ে পরদিন গেলাম গুলশান-২ সিটি কর্পোরেশনের অফিসে। কিন্তু সেখানে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট নাকি বসেন না। ওরা পাঠালো উত্তর নগর ভবনে। সেখানেও একই অবস্থা। ওরা জানালো উত্তরার দক্ষিণ নগর ভবনে ম্যাজিস্ট্রেট থাকলেও থাকতে পারেন। শেষ পর্যন্ত জানা গেল জজ কোর্টে গেলে ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়া যাবে অবশ্যই। কাউকে অনুরোধ করলে এবং সব কাগজপত্র দেখালে তিনি হয়ত এফিডেভিটে স্বাক্ষর করে দিবেন।


এখনও পর্যন্ত সেই স্বাক্ষর নেয়া হয় নি। এফিডেভিট তৈরি করে বসে আছি। এটা নিয়েও আরেক কাহিনি। এফিডেভিটে কী লিখতে হবে, জানি না। নোটারি করে যারা, বনানীতে এরকম একটা অফিসে গেলাম। সেখানকার এক ভদ্রলোক ব্যাংক থেকে একটা টেমপ্লেট নিয়ে আসতে বললেন। ব্যাংকে যোগাযোগ করলাম। ওদের কাছে নাকি টেমপ্লেট নাই কোনো। তবে যে ভদ্রলোকের কাছে সঞ্চয়পত্র নগদীকরণ বন্ধের দরখাস্ত দিয়ে এসেছিলাম, ঘটনাক্রমে তিনি পরিচিত চেহারা ছিলেন, কারণ তাকে আগে গুলশানের একটা শাখায় দেখেছিলাম। এটা বলতে তিনিও খুশি হয়ে একটা ব্যক্তিগত সুবিধা দিয়ে সাহায্য করলেন। গুলশান শাখার এক অফিস সহকারীর নাম বলে দিলেন। তার সাথে যোগাযোগ করলে নাকি পুরাতন কোনো ফাইল থেকে সব কাগজপত্রের কপি পাওয়া যাবে। গেলাম। তাকে খুঁজে বের করলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা বা চল্লিশ মিনিট পর যখন বের হলাম ব্যাংক থেকে, আমার কাছে তখন পুরো এক সেট কাগজ। ফটোকপি করা। এফিডেভিটের টেমপ্লেটটা ওখান থেকেই পাওয়া গেল।

সংবাদপত্রে "হারানো বিজ্ঞপ্তি" দেয়াও তুলনামূলক বেশ সহজেই হয়ে গেল। প্রথমে গিয়েছিলাম গুলশানের একটা দোকানে। আমার অফিস যেহেতু ওখানেই। সেখানে ওরা হিসেব করে জানালো প্রতিটাতে খরচ পড়বে প্রায় বারোশো টাকা। তাও আবার শ্রেণীবদ্ধ অংশে। আর যদি ইঞ্চি হিসেবে দিতে চাই, তাহলে আড়াই হাজার টাকার মতো লাগবে। "প্রথম আলো"-তে মনে হয় তিন হাজারের উপর। শুনে রীতিমতো অবাক হলাম। এটা যে এত খরুচে ব্যাপার, ধারণা ছিল না। অন্য জায়গায় খোঁজ নিলাম। শেষ পর্যন্ত এক বন্ধুর সাহায্য নিয়ে মিরপুরের এক এজেন্ট পাওয়া গেল। তার কাছেই দিয়ে দিলাম। সব মিলিয়ে এক হাজার টাকা বেঁচে গেল।

এতকিছু যে হয়ে গেছে, বাসায় বিস্তারিত কিছুই বলি নি। শুধু শুধু চিন্তা করবে ভেবে। মজার ব্যাপার হলো, সকালে বাসা থেকে কল করলো। তখন আমি অফিসে। পত্রিকায় "হারানো বিজ্ঞপ্তি" চোখে পড়ায় কল করেছে। পত্রিকার এই অংশটাও যে কেউ পড়তে পারে বা এটা যে এভাবে বাসায় ধরা পড়ে যাবে, একদমই ধারণা করতে পারি নি! কোনোভাবে এটা-সেটা বুঝিয়ে এড়ানো গেল অবশ্য। তবে সবচেয়ে মজার ঘটনা ঘটলো রাতে। আমার সেই হারিয়ে যাওয়া সঞ্চয়পত্র খুঁজে পাওয়া গেল। বাসায়। এবং আমার নিজের ঘরেই। যা নিয়ে এত দৌড়াদৌড়ি এবং এত এত কাহিনি, সেটা পুরোটা সময় হাতের নাগালেই ঘাপটি মেরে ছিল এভাবে!
এতকিছুর পর বোকার মতো হাসি দেয়া ছাড়া আর কীই বা করার থাকে!

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা