কাছে আসার গল্প

 

আমাদের বিয়ের বয়স বছর ১৪ পেরুবে।

পরিবারের সম্মতিতেই বিয়েটা হয় মেডিকেল থার্ড ইয়ারে থাকতে। আশেপাশের যেকোন প্রেম মেনে নেয়া সমাজকেই তখন কেন জানিনা আমাদের বিয়েটাকে মেনে নিতে অনেক হট্টগোল এবং মানসিক কসরত করতে দেখেছি। প্রেম করলে লেখাপড়ার যদি ক্ষতি হয়, বিয়েতে নাকি ক্যারিয়ারের রীতিমত সর্বনাশ! তার উপর সম বয়সী জামাই-বউ ধ্বংস যেন অনিবার্য। দু'জনই মহা প্যাড়ার মধ্যে দিয়ে গেছি! একটা মেয়ের ২১-২২ বছর বয়সে বিয়ে তাও মানা যায়! ছেলের বিয়ে!! সে যেন এক ছি! ছি অবস্থা।

একজন ঢাকা মেডিকেলে আরেকজন চট্টগ্রাম মেডিকেলে পড়ি। শুরু হল আমাদের হাইওয়ে সংসার। একে লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ, তার উপর টা ভিন্ন মেডিকেল, তার উপর ছিলাম টাকা/ টাকা প্রতি মিনিট কল রেটের জামানায়! ইন্টারনেট নাই। যেন, 'মাঝে মাঝে তব দেখা পাই ' মার্কা অবস্থা! প্রায় ১৪ বছর আগে আমাদের নতুন সংসারের খরচ চলতো গুণে গুণে। বাসা থেকে থাকা-খাওয়ার খরচ আসতো।পড়া যাতে নষ্ট না হয় তাই দু'জন টা করে টিউশনি করতাম। আমাদের মাথায় ছিল, বাবা মায়ের যত সামর্থ থাকুক না কেন আমাদের শখ আহ্লাদ মেটানোর দায়িত্ব নিতে তারা বাধ্য নন। তাই নিজেদের শখের লাগাম নিজেদেরই টানত হবে। আর এভাবেই আমরা বেশ ভাল ছিলাম। শখ আর সাধ্য মিলিয়ে নিলে, সাথে লোক দেখানো ব্যাপারটা নিয়ে খুব মাথা ব্যথা না থাকলে অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকা খুব সম্ভব বলে আমাদের দু'জনেরই বিশ্বাস।জীবন থেকেই শিখেছি।

আমরা মেডিকেল লাইফে খুব আনন্দ নিয়ে পড়েছি।
একজন অন্যজনের মাস্টার ছিলাম ঠিকই তবে দুজনের কেউই আঁতেল ছিলাম না!
আস্তে আস্তে মোবাইল কল রেট যখন কমল ডিজুস রাত জাগা অফারে - কতক্ষণ আর 'তোমাকে ছাড়া আমার চলেনা' বলা যায়! আইটেমের পড়া নিজেদের মধ্যে ডিস্কাস করার অভ্যাস করে ফেললাম। এই ডেমো খাওয়া এবং ডেমো দেওয়ার আন্ডারস্ট্যান্ডিং টা - আমাদের মধ্যে অদ্ভূত রকম ভাল ছিল! তাই বড়সড় ফেইল ছাড়াই মেডিকেল লাইফটা ভালই কেটেছে।

আমরা দু'জনই আমাদের মাতৃত্ব এবং পিতৃত্ব ব্যাপারটা মন থেকে খুব ভালবেসেছি। আমাদের সন্তান আমাদের পড়ায় কখনো বাঁধা হয়নি বরং ওরাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। প্রতিটি pregnancy তে অসম্ভব মাত্রায় Emotionally draining & Physically intolerable অবস্থায় গেলেও কেবল একসাথে শক্ত থাকা এবং একে অন্যে পড়ার খেয়াল রাখাতে আমরা যেটা পেরেছি সেটা হল, শিক্ষাজীবনে বড়সড় কোন গ্যাপ ছাড়া মাত্র মাস আগে পরে আমার দু'জন কম বয়সেই আমাদের পোষ্টগ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করি। আমার বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ ছিল নিজের কাবিনের টাকা হাতে পাওয়া যে ব্যাপারটাতে আমি নিজে কিনা বিন্দুমাত্র সিরিয়াস ছিলাম না!

বিয়ের অনেক বছর পর এক দুপুরে এতোগুলো টাকা হঠাৎ নিজের একাউন্টে আসতে দেখে জামাই কে ফোন দিলাম হন্তদন্ত হয়ে! সে বলল- অস্থির হবার কিচ্ছু নেই। বিয়ের কাবিনটা যখন হয় সেটা তখন ওর সামর্থের পুরোপুরি বাইরে ছিল। তাই একটু একটু করে টাকাটা জমিয়েছে যাতে পুরো টাকা টা আমি পাই। বউ মাফ করলেই মাফ টাইপ ন্যাকা ন্যাকা নাটকে না পড়ি! এবং টাকাটা দেয়, আমার শ্বশুর নন কারন এটা ওর উপরে ফরজ। কাবিন কোন ছেলেখেলা না। এটা নাকি আমার অধিকার! বিয়ে কোন মজা না। এটা একটা worship for the sake of Allah.



হাদিসে এসছে - বিয়ে, সন্তান, হজ্বের নিয়তে নাকি আয় বাড়ে। আমি এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি কারন এর সত্যতা আমি নিজেদের জীবনে দেখেছি। আমার সিম্পলি মনে হয়েছে, এই বিষয়গুলো আমাদের মানুষ হিসেবে পরিপক্ক এবং অনেক বেশি দায়বদ্ধ করে।অহেতুক বিনোদন, অকারন সময় নষ্টের ফাঁদ থেকে বাঁচায়। আমাদের পরিশ্রম করার মানসিকতা তৈরি হয়। আমরা বুঝি, Temptation এর দুনিয়ায় নিজের সব Desire মিটিয়ে নেয়াই সুখ না, সুখ টা অন্যের জন্যে দায়িত্ব নেয়া, অন্যের জন্যে ছাড় দেয়া, অন্যকে ভালোবাসার মধ্যে দিয়েই আসে - হোক সে স্বামী/স্ত্রী,সন্তান বা পরিবার। প্রেম আমাদের কাছে কখনোই 'বিনোদন' ছিল না বরং ছিল 'দায়িত্বশীলতা' শব্দটিরই সমার্থক।

এই আমাদের কাছে আসার সাহসী গল্প। কুরআনের একটা আমার আমার বড্ড প্রিয় এবং এই আয়াতটা নিজের অজান্তেই আমার চোখ ভিজিয়ে দেয়-"অতঃপর, তোমরা তোমার রবের কোন কোন নিয়ামত কে অস্বীকার করবে?"
(May Allah grant a house for us in His jannah.)

 

©Dr. Shusama Reza

পাবলিকিয়ান

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা