গল্পঃ "জ্বীন প্রতিবেশী" --- পর্বঃ ১০

গল্পঃ "জ্বীন প্রতিবেশী"

পর্বঃ ১০ 



সালামান বেগ তার স্ত্রী নার্গিস বেগ পাশাপাশি বসে আছেন। তাদের এতো বড় প্রাসাদ প্রায় খালি পরে আছে।আজ অনেক দিন হচ্ছে তাদের ছেলে, মেয়ে এখানে নেই। সালমান বেগের বোনের মেয়েকে তাদের জ্বীন সমাজে ফিরিয়ে নিয়ে অাসতে আহমাদ আর আফসানাকে পাঠিয়েছেন তার পিতা সোলায়মান বেগ। তার পালিত কন্যা সাবরিন তার মানব স্বামীকে যাবৎ জীবন কারাদণ্ড থেকে রেহাই দেয়ার জন্য তাদের কন্যা কে খুবই দরকার।

সোলায়মান বেগ তার পালিত কন্যা সাবরিনের সাথে খুব অভিমান করেছিলেন মানব স্বামী গ্রহণ করার কারনে।কিন্তু পরবর্তীতে যখন দেখলেন, সাবরিন এক কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে, যার দেহে মানব রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, তখন তার মন গলে যায়। তিনি তার চল্লিশ দিনের নাতনির মায়ায় পরে যান।
তিনি চেয়েছিলেন সবাই এবার এক সাথেই থাকবেন তাদের প্রাসাদে।কিন্তু জ্বীন সমাজের কিছু অংশের বিরোধীতার মুখে পরে তিনি তার প্রাধান্য হারিয়ে নাতনি কে মানব সমাজের কাছে লালন পালন করতে দিয়ে দেন আর মেয়ে এবং তার মানব জামাতা কে আজীবনের জন্য কারাবন্দী হতে হয়।

সোলায়মান বেগ তার নাতনির নাম রাখেন! 'বিলকিস' কারন বহু বছর অাগে 'সাবা'নামক এক জাতি ছিলো। তাদের রানীর নাম ছিলো বিলকিস। তার পিতা অথবা মাতার মধ্যে একজন জ্বীন এবং আরেক জন মানুষ ছিলেন!
কিন্তু সোলায়মান বেগ যখন তার নাতনি বিলকিস কে মানব জাতির কাছে লালিত পালিত হতে দেন তখন তিনি তার নামের ব্যপারে তাদের কিছু জানান নি।তাই মানব সমাজে যেয়ে তার নাম রাখা হয় 'অনিলা।'
সোলায়মান বেগ ভালো করে জানেন,যখন একজন মানুষ আর জ্বীনের সন্তান হয় তাদের বৈধ বিবাহের মাধ্যমে ,তখন সেই সন্তান কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠে। 

সালমান বেগ তার বাবা সোলায়মান বেগের ঘরে আসেন। তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে কতটা চিন্তিত তিনি। পিতার পাশাপাশি যেয়ে বসলেন।
--”
আব্বুজান,আজ কয়েক দিন থেকে আমার কাছে কিছুই যেন ভালো ঠেকছেনা।আহমাদের মায়ের কাছেও অনুরূপ। " সামলান বেগ মাথা নিচু করে বললেন পিতাকে।
--“
কেনো? কি হয়েছে বেটা? কি নিয়ে এতো পেরেশানি তে আছো?সব কিছুতো ঠিকঠাকই চলছে!"
--“
না অাব্বু জান,ঠিক নেই। অামার কয়েকদিন থেকেই মনে হচ্ছে অাপনার অাদরের নাতি,নাতনি কোনো সমস্যায় পড়েছে। অাবার হতেও পারে এটা আমার মনের ভুল।” 
সালমান বেগের কন্ঠে যথেষ্ঠ চিন্তার ছাপ।
--"
বেটা ওদের নিয়ে কেনো দুঃচিন্তা করছো।রাশিদকে তো পাঠিয়েছি ওদের সাথে।কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়!"
সালমান বেগ তার পিতার কথা শুনে অারো বেশি অস্থির হয়ে ওঠেন।
কেনো যে তার বাবা রাশিদ বেগ কে এতো ভরসা করেন তিনি ভেবে পাননা।
রাশিদ বেগের অতীততের কর্ম কান্ডের কারনে তাকে কখনোই মন থেকে ক্ষমা করতে পারেন নি তিনি।কিন্তু পিতার সিদ্ধান্ত কে শ্রদ্ধা দেখাতেই তার সাথে সালমান বেগ তার কলিজার টুকরা সন্তানদের এতো দূর পাঠিয়েছেন।

--"
বেটা,আমার নাতি নাতনির চিন্তা যদি তোমাকে এতই পেরেশানিতে ফেলে দেয়, তাহলে আমি বলবো আজই একজন "জ্বীন খাবরি" কে পাঠিয়ে দাও তাদের খবর জেনে আসার জন্য।
তাছাড়া ভুলে গেলে হবেনা,নতুন চাঁদ আসমানে দেখা দিতে অতি অল্প সময় বাকী অাছে।"

সালমান বেগ জানেন,তার পিতা নতুন চাঁদের কথা বলে কি বুঝাতে চাইছেন। তার পালক বোনের মেয়ে বিলকিসের মানব শরীরে নতুন চাঁদ ওঠার সাথে সাথে জ্বীন দের সমস্ত শক্তির উপসর্গ দেখা দিবে স্পষ্ট ভাবে ।সে সময় আহমাদ বা আফসানার সেখানে থাকা জরুরি।

সালমান বেগ তার পিতার সাথে আর কিছু না বলে একজন জ্বীন খাবরির সাথে কথা বলতে চলে যান।যতক্ষন পর্যন্ত তার সন্তান দের ভালো থাকার খবর না পাচ্ছেন,তার মনে শান্তি অাসবেনা!

অনিলার শরীর খারাপের লক্ষন গুলি বেড়েই চলছে। তার মনে হচ্ছে তার শরীরের চামড়া পুড়ে পুড়ে গলে পড়ছে। সে নিশ্চিত মারা যাবে।
মেয়ের কষ্ট দেখে লাবনি ইসলাম মুখ চাপা দিয়ে কাঁদছেন।
যেই মেয়েকে তিনি এতো বছর ধরে লালন পালন করলেন তার এমন কষ্টের সময় তিনি কিছুই করতে পারছেন না।
অনিলাকে কোলে তুলে দেয়ার সময় লাবনি ইসলামের বাবা একটা তাবিজের পুটলির সাথে কিছু লিখা সহ একটা কাগজও দিয়েছিলেন।
লাবনি সেখানে পড়েছেন, অনিলা যখন সাধারন মানুষ থেকে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন জ্বীনজাতি দের একজন হওয়া শুরু করবেন তখন তার মৃত্যুসম কষ্ট হবে। এসয় তাকে কোনো প্রকার ঔষধ সেবন করানো যাবেনা।একটা বদ্ধ ঘরে আটকিয়ে রাখতে হবে তাকে। কিন্তু এসময় যদি জ্বীনজাতি হতে কেউ অনিলার পাশে থাকে তাহলে তার উপস্হিতির কারনে অনিলার এই ভয়ানক যন্ত্রণা কিছুটা কম হবে।
কিন্তু লাবনি ইসলাম জানেনা,অনিলার এই সময় কেউ তার পাশে থাকবে কিনা।
লাবনি ইসলাম তার বাবার প্রিয় মিত্রের কথা ভাবেন।সে কি আসবেন তার নাতনির এমন কষ্টের সময়ে।নাকি কাউকে পাঠাবেন?কিন্তু লাবনি ইসলাম কিভাবে বুঝবেন যে তারা এসেছে?তিনি ভাবতে থাকেন। পাশের ঘর থেকে অনিলার গোংগানির শব্দ পাচ্ছেন তিনি।
নিঃশব্দে চোখের পানি মুছলেন লাবনি ইসলাম।

সারাটা আকাশ ভয়ংকর কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে।বাতাসো খুব জোরে বইছে।যে কোনো সময় ভীষন ঝড় শুরু হতে পারে।
আফসানা বারান্দায় দাড়িয়ে আছে।তাকে খুব ভীতো দেখাচ্ছে। তার ভাই আহমাদের কোনো খবর নেই। সে এই খবর তাদের প্রাসাদেও পৌছাতে পারছেনা কোনো ভাবে। অাফসানা মোটামোটি নিশ্চিত যে তার ভাই কোনো বিপদে পরেছে। কিন্তু এখন এই পরিস্হিতি থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় জানা নেই তার।তার ইচ্ছা করছে সব কিছু বাদ দিয়ে ভাই কে খুঁজে নিয়ে আসতে।

খুব জোরে বিদ্যুৎ চমকালো আকাশে।আফসানা ভয় পেয়ে ভেতরে চলে এলো। জ্বীন জাতির জন্য ঝড়, বাজ এবং বিদুৎ চমকানো খুবই বিপদজনক। 
অাফসানার হঠাৎ মনে হলো তার ঘরে কেউ ঢুকেছে।সে ভয়ানক হুংকার ছেড়ে বলল,
"
কে এসেছো এখানে,?যদি নিজের জান প্রিয় হয়ে থাকে,এই মুহূর্তে স্থান ত্যাগ কর।" আফসানার চোখের রং পরবর্তন হয়ে সবুজ হয়ে গেলো।তার চোখ থেকে যেন ঠিকরে ঠিকরে সবুজাভ আগুন বের হচ্ছে।

-- "
আমাকে জ্বীন প্রধান এখানে পাঠিয়েছেন।আমার নাম আসাদ। দয়া করে আপনি শান্ত হন।" একটি শীতল কিন্তু গম্ভীর কন্ঠ আফসানাকে বলল।
--"
সামনে হাজির হয়ে কথা বলো।"অাফনার কন্ঠ এখনো শান্ত হয়নি।তার চোখ রাগে জ্বলছে।

একটি লম্বা পুরুষের অবয়ব ধীরে ধীরে আফসানার সামনে প্রকাশ পায়। সে মাথা নিচু করে আফসানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
--"
আব্বু জান তোমাকে পাঠিয়েছেন?"
--"
জ্বী।তিনি বেশ কয়েকদিন যাবৎ আপনাদের নিয়ে দুঃচিন্তায় অাছেন।আপনারা এখানে ভালো আছেন কিনা আমাকে দেখতে পাঠিয়েছেন।"

আফসানার মনটা নরম হয়ে আসে।সে মনে মনে আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া জানায়।
তাদের পিতার মনে মহান আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন যে তার সন্তানেরা পেরেশানিতে আছেন। 
"
আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি।" অাফসানা উত্তর দেয়।সে মনে মনে ভাবে,আহমাদ ভাই তাহলে প্রাসাদে পৌছায়নি।কারন পৌছালেতো তাদের অাব্বুজান এই খাবরি কে এখানে পাঠাতেন না। আফসানার ধারনাই তাহলে ঠিক।তার ভাই বিপদে পড়েছে।সে খাবরি আসাদ কে বলে,
--"
কিন্তু আহমাদ ভাই বেশ কয়েক দিন আগে প্রাসাদে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন।কিন্তু ফিরে আসেন নি।"একথা বলে আফসানা বিমূর্ষ হয়ে পরে। "ভাইজান আমাদের চাচাজান রাশিদ বেগ এর গায়েব হওয়ার খবর পৌছে দিতে রওনা হয়েছিলেন।এখন বুঝতে পারছি তিনি পৌছাননি প্রাসাদে।"
--"
দয়া করে আপনি পেরেশান হবেন না। আমি একটি খবর পেয়েছি।কিন্তু এটা হুজুর প্রধান কে জানানো হয়নি।আমি যখন প্রাসাদ থেকে এখানে আসার উদ্দেশ্যে বের হই তখনি আমাকে একজন পাহাড়াদার এই খবর দিয়েছেন।আমি খবরের সত্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে হুজুর প্রধান কে পেরেশানিতে ফেলতে চাইনি।"
--"
কি খবর পেয়েছো?কোনো ভনিতা না করে জলদি বলো"অাফসানা অাবার ভয়ানক হুংকার দিয়ে বলল।
তার হুংকার শুনে খাবরি আসাদ ভয়ে কুকড়ে যায়।সে মাথা নিচু করে বলে,
--"
কয়েক দিন আগে প্রাসাদের একজন জ্বীন পাহারাদার এর শিশু পুত্র প্রাসাদের বাহিরে খেলা করার সময় ছোট হুজুর অাহমাদবেগ কে প্রাসাদের দিকে আসতে দেখে।কিন্তু প্রাসাদে প্রবেশ করার আগেই উনাকে ভয়ংকর রকমের কালো ধোয়ার মত কিছু ঘিরে ফেলে। ওই শিশুটি এটা দেখার সাথে সাথে তার পিতাকে ডেকে আনতে যায়।কিন্তু সে এসে দেখে সেখানে কিছু নেই।"
এইটুকু বলে খাবরি আসাদ থেমে যায়।
আফসানা তাদের বিশাল আরাম কেদারায় বসে পরে।সে বুঝতে পারছে তার ভাইয়ের সাথে কি হয়েছে। তাদের প্রাসাদের মধ্যে শুধু তিন জনের কালো ধোঁয়ার মত রূপ ধরার ইখতিয়ার আছে।সেই তিনজন হচ্ছেন তাদের দাদা সোলায়মান বেগ,তাদের পিতা সালমান বেগ,এবং তাদের দুঃসম্পর্কের চাচা রাশিদ বেগ এর।

রাগে আফসানার চোখ ঠিকরে আগুন বের হচ্ছে।রাশিদ বেগ এর উপর প্রচন্ড ঘৃনা হচ্ছে তার।দাদা জান কত ভরসা করে তাকে পাঠিয়েছিলেন তাদের সাথে।আর এই রক্ষক ভক্ষকের রূপ নিলো!দাদাজানের ভুল হয়েছে তাকে অাবার বিশ্বাস করে।
কিন্তু অাহমাদ ভাই কে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে? আফসানা ভাবতে থাকে!সে বুঝে উঠতে পারছেনা এই খবর প্রাসাদে তার পিতা কে জানাবে কিনা।নাকি নিজেই ভাইকে উদ্ধারের জন্য বেড়িয়ে পড়বে।
--"
আপনি চাইলে আমি প্রাসাদে এই খবর টি পৌছে দিয়ে আসতে পারি। হুজুর প্রধান খোঁজ লাগাবেন যে কার এতো বড় দুঃসাহস হয়েছে যে ছোট হুজুর কে কয়েদ করার!!"

--"
নাহ।এখনি আব্বুজান কে বলার দরকার নেই।কিন্তু কে ভাইজান কে নিয়ে গেছে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। "আফসানা খাবরি আসাদের দিকে জ্বল জ্বল ভয়ানক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে।
--"
দয়া করে আপনি আমাকে তার নাম বলুন।আমি এখনি তার সমস্ত শক্তি ধ্বংস করে দিয়ে তাকে হত্যা করে আসবো।শুধু দয়া করে তার নামটি বলে আমাকে হত্যা করার অনুমতি দিন।"
আসাদের কন্ঠে অানুগত্যের দৃঢ়তা প্রকাশ পাচ্ছে। সে পারলে এক মূহুর্তের মধ্যে তাদের সমাজ প্রধানের পূত্র কে মুক্ত করে আনে শত্রুর কয়েদ থেকে!!


চলবে..........

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

বেশি বার পড়া হয়েছে

একজন রিক্সা-ওয়ালা